দখল হয়ে যাচ্ছে পাড়ও, সঙ্কটে দ্বারকা

এক দিকে অগুনতি হোটেল-লজ-রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্য পদার্থ। অন্য দিকে, নদীর পাড় দখল করে ভুরি ভুরি অবৈধ নির্মাণ। পাশাপাশি চলেছে পুলিশ-প্রশাসনের দীর্ঘ কালের নীরবতা। আর এই সব কিছুর সম্মিলিত আঘাতই প্রাণ ছিনিয়ে নিচ্ছে দ্বারকা নদের! অন্তত এমনটাই দাবি বর্তমান জেলা প্রশাসনের। তাই বেড়ে চলা দূষণ রোধের সঙ্গে সঙ্গেই কীভাবে নদীর দখলদারি রোখা যায়, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে প্রশাসনের কর্তাদের মধ্যে।

Advertisement

অরুণ মুখোপাধ্যায়

তারাপীঠ শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২৭
Share:

নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে লজ, হোটেল। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

এক দিকে অগুনতি হোটেল-লজ-রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসা বর্জ্য পদার্থ। অন্য দিকে, নদীর পাড় দখল করে ভুরি ভুরি অবৈধ নির্মাণ। পাশাপাশি চলেছে পুলিশ-প্রশাসনের দীর্ঘ কালের নীরবতা। আর এই সব কিছুর সম্মিলিত আঘাতই প্রাণ ছিনিয়ে নিচ্ছে দ্বারকা নদের!

Advertisement

অন্তত এমনটাই দাবি বর্তমান জেলা প্রশাসনের। তাই বেড়ে চলা দূষণ রোধের সঙ্গে সঙ্গেই কীভাবে নদীর দখলদারি রোখা যায়, তা নিয়েও ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে প্রশাসনের কর্তাদের মধ্যে। ইতিমধ্যে তারাপীঠ এলাকা পরিদর্শন করে দূষণ ও বেআইনি দখলদারি চাক্ষুস করে এসেছেন জেলা প্রশাসনের কর্তারাও। প্রশাসনের মূল লক্ষ্য দখলদারি ভেঙে দ্বারকা নদকে উন্মুক্ত করে আগের অবস্থায় ফেরানো। তবে, সেই কাজ যে এত সহজে হবে না, তা মানছে প্রশাসনও। সে কথা স্বীকার করেই জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীও বলছেন, “জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ মতো আপাতত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা ভাবা হচ্ছে। আমরা ধাপে ধাপে বিষয়টি নিয়ে এগোবো। প্রথমেই দ্বারকা নদকে দূষণমুক্ত করাতে যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার পরে দ্বারকা নদকে দখলমুক্ত করার বিষয়টি ভাবব। তবে, দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবেই।”

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়েই বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ হয়েছিল। সে সময় সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখিও হয়। অভিযোগ উঠেছিল, দ্বারকা নদের পাড় বুজিয়ে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাতটি লজ গড়ে উঠেছে। ওই সব অবৈধ নির্মাণের পাশাপাশি তারাপীঠ এলাকায় সরকারি জমি দখল করে লজ, রেস্তোরাঁ গড়ে উঠছে বলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল অভিযোগ তুলেছিল। অভিযোগ উঠতেই প্রশাসন তৎকালীন কর্তারা নড়েচড়ে বসেছিলেন বটে। কিন্তু, পরিস্থিতি যে খুব একটা বদলায়নি, তা দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তারাপীঠের এক প্রবীণ বাসিন্দার আক্ষেপ, “আসলে যত দিন গিয়েছে, তারাপীঠে পর্যটন ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সেই সঙ্গে গোটা ব্যবস্থাটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকে দুর্নীতি গ্রাস করেছে। দ্বারকা বাঁচানোর দায়িত্ব যাদের, তারা বিষয়টি উপেক্ষা করে গিয়েছেন। আর দূষণ-দখলদারির চোটে দ্বারকাও ক্রমে নদ থেকে নালায় পরিণত হয়েছে!”

Advertisement

এ দিকে, জাতীয় পরিবেশ আদালতে দ্বারকা নদের দূষণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি এখনও শেষ হয়নি। আগামী ৯ মার্চ পরবর্তী শুনানির আগেই দ্বারকাকে দূষণমুক্ত করতে কী কী ব্যবস্থা প্রশাসন নিয়েছে, তা জানাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে যার মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বারকা নদের পুনরুজ্জীবনের জন্য এত পদক্ষেপ করতে হচ্ছে, সেই আইনজীবী জয়দীপ মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বিশেষজ্ঞের এক প্রতিনিধিদল তারাপীঠ এলাকার দূষণ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট দিয়েছে। জয়দীপবাবু বলেন, “রিপোর্ট বলছে, তারাপীঠে হোটেল-লজগুলিতে প্রায় ১৩ হাজার শয্যা রয়েছে। তেরো হাজার মানুষ এক সঙ্গে তারাপীঠে এলে, তাঁদের ব্যবহৃত বর্জ্য নিকাশের কোনও ব্যবস্থা নেই। যতটুকু পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা রয়েছে, তা খুবই দুর্বল। সেই সঙ্গে বেশ কিছু লজের আবাসিকদের ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ সরাসরি চাষের জমিতে গিয়ে পড়ছে। ফলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত ও বিষাক্ত হচ্ছে।” এরই সঙ্গে রয়েছে তারাপীঠ মন্দির এবং বাজারের নানা সামগ্রীও দ্বারকা নদকে বিপন্ন করে তুলছে বলে জানা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জয়দীপবাবুর মত, সমস্ত রকম ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি রাজ্য সরকারের তারাপীঠে পুরসভা গড়া উচিত। তা হলে দূষণ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করছেন।

নদী বুজিয়ে অবৈধ নির্মাণের অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাননি ‘তারাপীঠ লজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি তথা তৃণমূলের রামপুরহাট ২ ব্লক সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “যা কিছু অবৈধ নির্মাণ হয়েছে, সবই বাম আমলে। এখন এ নিয়ে কী করা যায়, তা ভাবনা-চিন্তা করছি।” এ দিকে, নদীর দখলদারির অভিযোগ মানতে চাননি লজ মালিকদের অনেকেই। তাঁদের দাবি, তাঁদের মালিকানা থাকা জমিই বরং নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। যদিও নদী বিশেষজ্ঞ তথা বিশ্বভারতীর ভূগোলের অধ্যাপক মলয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, “নদী যে জায়গা দখল করবে, তা নদীরই। নদীকে খেলতে দিতে হবে। কোনও বাধা দেওয়া চলবে না।”

এ দিকে, দূষণ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই তারাপীঠ মন্দিরের প্রতি দিনের প্রণামী ফুল মল্লারপুরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারাপীঠ মন্দিরের সেবাইত সমিতির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায় বলেন, “ওই সংস্থা মন্দিরের ফুল সংগ্রহ করে জৈব সার তৈরি করবে।” আবার অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলাপরিষদ) বিধান রায় জানিয়েছেন, তারাপীঠে দূষণ বন্ধ করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেখানে পুরসভা গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। অন্য দিকে, সদ্য গঠিত ‘রামপুরহাট-তারাপীঠ উন্নয়ন পর্ষদ’-এর চেয়ারম্যান আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “এই মুহূর্তে নদীর নাব্যতা বাড়ানোর দিকে আমরা বেশি গুরুত্ব দেব। ভূমি ও সেচ দফতরের সঙ্গেও আলোচনায় বসব।”

বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলা ভূমি ওভূমি সংস্কার আধিকারিক নীলকান্ত বিশ্বাস। অন্য দিকে, সেচ দফতরের ময়ূরাক্ষী উত্তর বিভাগের বিভাগীয় সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়র সুজিত কোনার বলেন, “আমি গত বুধবারই তারাপীঠে গিয়েছিলাম। নদী দূষণের বিষয়টি দেখছি। ওখানে সেচ দফতরের জায়গা দখল করে কোনও লজ গড়ে ওঠেনি। তবে, নদীতে নানা রকম ময়লা ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়েছে।” তিনি আরও জানান, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় আধিকারিকের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় যা যা পদক্ষেপ, তা দফতর নেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন