বিপণনের হেরফেরে যে ছবি

ধান বাতিলেই দিশা মুক্তিনগরে

জমিতে বছরের পর বছর ধান লাগিয়ে ক্ষতির মুখ দেখার থেকে বিকল্প পথ খোঁজাই শ্রেয়। জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা রকম সব্জি ফলিয়ে এ নিয়েই দিশা দেখাচ্ছেন খয়রাশোলের মুক্তিনগর এবং আশপাশের চারটি গ্রামের চাষিরা।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৫ ০২:২৬
Share:

ফুলকপি চাষের পরিচর্যায় ব্যস্ত মহিলা। রবিবার দুপুরে চাপলা গ্রামে তোলা নিজস্ব চিত্র।

জমিতে বছরের পর বছর ধান লাগিয়ে ক্ষতির মুখ দেখার থেকে বিকল্প পথ খোঁজাই শ্রেয়। জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা রকম সব্জি ফলিয়ে এ নিয়েই দিশা দেখাচ্ছেন খয়রাশোলের মুক্তিনগর এবং আশপাশের চারটি গ্রামের চাষিরা।

Advertisement

রবিবার ওই সব গ্রামে গিয়েই প্রকৃত চিত্রটা ধরা পড়ল। ট্রাক্টরে রোটার (‌মাটি ঝুরঝুর করার যন্ত্র) লাগিয়ে জমির মাটি তৈরি করে দিচ্ছিলেন সাধন ব্যাপারী। আর সেই কাজের তদারকি করছিলেন মুক্তিনগর গ্রামের চাষি রামকৃষ্ণ মণ্ডল, দিলীপ মণ্ডলেরা। প্রায় বিঘে পাঁচেক জমি থেকে ফুলকপি তুলে সেখানেই মটরশুঁটি এবং পটল লাগানোর পরিকল্পনা করছেন রামকৃষ্ণবাবুরা। এখন আর কপির সেই দাম কোথায়! ঠিক পাশের মাঠেই আবার প্রায় দু’বিঘা জমিতে ফলতে শুরু করেছে সিম। সেখান থেকেই টাটকা সিম তুলছিলেন ভূবনচন্দ্র ঘরামি। জানালেন, অন্য জমিতে ইতিমধ্যেই মটরশুঁটি লাগিয়েছেন। তারই একপাশে রয়েছে পটলের খেতও। অন্য দিকে, প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে আলু লাগাচ্ছেন কৃষ্ণ চক্রবর্তী। শুধু আলুই নয়, লাগাবেন পেঁয়াজ ও গাজরও।

ঘটনা হল, মুক্তিনগর গ্রামের যে খেতেই তাকানো যায়, চার দিকে শুধু সব্জি চাষের প্রস্তুতি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বীরভূম নয়, বর্ধমান বা হুগলি জেলার কোনও খেত। তবে, এ ছবি শুধু ওই গ্রামেরই নয়, অজয় ও হিংলো নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় থাকা বালিতা, পারুলবোনা, চাপলা— সব গ্রামেই সব্জি চাষের রমরমা। জেলা উদ্যানপালন দফতর এবং কৃষি দফতর একযোগে বলছে, জেলার মধ্যে অন্যতম সেরা সব্জি ঠিকানা খয়রাশোলের এই অংশই। এই চারটি গ্রামের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ দেড় হাজার একর মতো। বাস করেন প্রায় ৮০০ পরিবার। যাঁর ৯০ শতাংশই সব্জি চাষি। বহু বছর আগে এক সময় বাংলাদেশ থেকে এসে ওই দু’টি নদীর চর এলাকায় বসতি গড়ে চাষবাসের পরিভাষাই বদলে দিয়েছেন তাঁরা।

Advertisement


সিম তুলছেন মুক্তিনগরের এক চাষি। —নিজস্ব চিত্র

ওই চারটি গ্রামের বাসিন্দারাও জানাচ্ছেন, সব্জি চাষ থেকেই তাঁদের জীবীকা নির্বাহ হয়। ধান উৎপাদন করেন শুধুমাত্র নিজেদের খাওয়ার জন্য। কখন কী সব্জি চাষ করলে বাজার থেকে ভাল দাম পাওয়া যাবে, সেই চিন্তাতেই মগ্ন থাকেন চাষিরা। কাছের দুবরাজপুর বা অন্য বাজারের থেকে বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর এবং হরিপুর বাজারেই উৎপাদিত সব্জি বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী সেখানকার চাষিরা। সকলেই বলছেন, ওখানে সময়মতো সব্জি পৌঁছে দিতে পারলে ভাল দাম মেলে।

জানা গেল, অনেক চাষিই এ বার ঝুঁকি নিয়ে শ্রাবণ মাসে ফুলকপি লাগিয়ে পুজোর বাজারে ভাল দাম পেয়েছেন। এক একটা কপি ৩০-৩৫ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বাজার দর তলানিতে। ভূবনবাবু যেমন জানাচ্ছেন, এখন বাজারে টাটকা সিম নিয়ে গেলে ২৫০ টাকা পাল্লা (অর্থাৎ কিলো প্রতি ৫০ টাকা) পাবেন। পড়শি চাপলা গ্রামের বাপি প্রামাণিক, বিশ্বজিৎ রায়রা পুরোদমে আলু লাগানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। সেই সঙ্গে বেশ কিছুটা জমিতে মটরশুঁটি, টম্যাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপিও থাকছে। অন্য কারও খেতে কোথাও লঙ্কা, কোথাও বেগুন, কোথাও লাউ তো কোথাও বড়বটি।

স্থানীয় পারুলবোনার চাষি বলরাম রায়, বালিতার মনা হলাদারের বা এলাকার অন্যান্য চাষিদের মিলিত বক্তব্য, একটা সময়ও জমি ফাঁকা থাকে না। এখানে দু’ধরনের সব্জি চাষ হয়। এক ধরনের সব্জি (যেমন পটল, লাউ) এক বছর থেকে যায়। অন্য ধরনের সব্জি জমিতে থাকে মাত্র তিন মাস। কখন কোন জামিতে মরসুম অনুযায়ী সব্জি লাগানো হবে, তার একটা পরিকল্পনা ছকে নেওয়া হয়। শুধু বাড়ির পুরুষেরাই নয়, মহিলারাও চাষের কাজ যথাসাধ্য সাহায্য করেন। সঙ্গে কৃষি দফতরের পরামর্শ তো রয়েইছে। এখন আবার কেউ কেউ ক্যাপসিকাম বা ফুল চাষের দিকেও ঝুঁকছেন। জেলা উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ আধিকারিক সুবিমল মণ্ডলও বিকল্পে চাষে ওই এলাকার চাষিদের ভাবনার প্রশংসা করছেন।

এ দিকে, উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিক না হলেও প্রায় একই বক্তব্য খয়রাশোল ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্যেরও। দেবব্রতবাবু বলছেন, ‘‘সব্জি চাষ ঠিকমতো করতে পারলে লাভ অনেক বেশি। ওই চারটি গ্রামের প্রতিটি পরিবারই সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে এটা করেন, উন্নততর কৃষিবিজ্ঞান মেনে করেন। এর ফলে উৎপাদন বাড়ে। আমাদের কাছে পরামর্শ চাইলে সেটা দেওয়ার চেষ্টাও করি। সার অনুখাদ্য, জীবাণুসার— এগুলোও চাষিরা নিয়ে আসেন।’’

তবে, বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়েও চিন্তিত এলাকার চাষিরা। তাই সাব-মার্সিবল পাম্প এবং প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা থেকে বাঁচতে ‘শেড নেটে’র মতো আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ তাঁরা করতে চান। তা হলে আরও ভাল ভাবে সব্জি চাষ করা সম্ভব বলে ওই চাষিদের মত। কৃষি ও উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিকেরা অবশ্য এ ব্যাপারে পাশে থাকার আশ্বাসই দিচ্ছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement