ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দু-দফায় বৃষ্টিতে নাবি ধসায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে জেলার আলু চাষ। কিন্তু তার পরিমাণ ঠিক কতটা, ফসল ঘরে তোলার সময় টের পাচ্ছেন আলুচাষিরা। আলু চাষিদের কথায়, এ বার ফলেনের ৫০ শতাংশের বেশি পাওয়া সম্ভব নয়। চাষিদের আশঙ্কা যে অমুলক নয় তা মানছে জেলা কৃষি দফতরও। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধু ফলন কম পাওয়াই নয়, নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এক দিকে যেমন আলুর আকার বাড়তে পারেনি। তেমনই খোসা সঠিক ভাবে পুরু না হওয়ার কারণে আলু বেশি দিন ভাল থাকবে না। সমস্যা হবে হিমঘরজাত করার ক্ষেত্রেও।
কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর জেলায় ২৩,৩০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল হেক্টর প্রতি ২৮,৫০০ কেজি। চাষ হয়েছে ১৮,০৭০ হেক্টর জমিতে। দেরিতে লাগানো আলু গাছই ধসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সহকারী কৃষি অধিকারিক (তথ্য) অমর মণ্ডল। তবে পরিস্থিতি কেমন জেলার একটি মহকুমার চিত্রতেই তা বোঝা যাবে। এ বার সিউড়ি মহকুমার মোট ৫৩৯৩ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হলেছিল এ বার। কৃষি দফতরের হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ জমির পরিমাণ প্রায় অর্ধেক। মহকুমা কৃষি আধিকারিক (প্রশাসন) শিবনাথ ঘোষ বলেন, “মূলত মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই আলু ঘরে তোলেন কৃষকেরা। ফলে যে সব চাষি মূলত হিমঘরে আলু রাখবেন বলে মনস্থির করে চাষ করেন, তাঁদের অনেকেই আলু তোলার কাজ শুরুই করেননি। কিন্তু যেটুকু জমিতেই আলু তোলার কাজ শুরু হয়েছে, দেখা যাচ্ছে আকারে ছোট হওয়ায় কাঙ্খিত ফলনের তুলনায় তা অনেক কম হয়েছে।” সাঁইথিয়ার কুনুরী গ্রামের চাষি গুরুপদ মণ্ডল, দাসপলসার মইদুল হক, মহম্মদবাজারের মুশারফ হোসেন, সিউড়ি ২ ব্লকের উৎপল মণ্ডলও একই কথা বলছেন।
চাষিরা জানাচ্ছেন আলুর এই ক্ষতি বোরো চাষে প্রভাব পড়বে। কারণ, আলু চাষের জন্য যে ঋণ নিয়েছিলেন, তা শোধ করে বোরো চাষের জন্য ফের ঋণ নিতেন তাঁরা। আলু চাষে ক্ষতি হওয়ায় অনেকে জমি তৈরি করেও ফেলে রেখেছেন। কৃষি দফতর সূত্রে খবর, এ বার ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে বোর চাষের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে। অন্যান্য বার এই সময় সীমার মধ্যে বেশির ভাগ জমির বোরো চাষ সম্পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত প্রায় ষাট হাজার হেক্টর জমিতে ওই চাষ হয়েছে। জেলায় অন্যতম আলু উৎপাদক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক। এই ব্লক ছাড়াও নাবি ধসার প্রকোপে নানুর, বোলপুর, লাভপুর ও ইলামাবাজার ব্লকেও আলু চাষে ক্ষতি হয়েছে। ঋণ নিয়ে বিঘে তিনেক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন, নবগ্রামের প্রান্তিক চাষি কেশব ভাণ্ডারী। তিনি বলেন, “ভেবেছিলাম আলু বিক্রি করে বাড়ির চাল মেরামত করব। কিন্তু এখনও যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে চাল মেরামত দূরের কথা কী করে দেনা মেটাবো ভাবছি।” নবগ্রামেরই তমাল মণ্ডল কিষাণ কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নিয়েছিলেন ৭৫ হাজার টাকা। আলু তুলে ওই ঋণ মিটিয়ে ফের নতুন করে ঋণ নিয়ে বোরো চাষ করবেন বলে ভেবেছিলেন তিনি। বিঘে দু’য়েক জমি বোরো চাষের জন্য তৈরিও করেছেন। কিন্তু আলু তোলার পরে তিনি আর ধান চাষ করতে হাত বাড়াননি। একই অবস্থা লাভপুরের ধনডাঙ্গার বিবেকানন্দ মণ্ডলেরও।
আলুচাষি ও কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ধান মাঠে থাকায় ও বৃষ্টির কারণে অন্য বারের চেয়ে এ বার আলু চাষে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে (একমাত্র যে সব চাষি ধান চাষ না করে শুধু আলু চাষ করবেন বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা ছাড়া)। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫-১৮ এবং ২৮ তারিখ থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত যে নিম্নচাপের আবহাওয়া ও বৃষ্টি চলেছিল তাতে নাবি ধসায় বহু আলুগাছ মরে গিয়েছিল। তাই বর্তমানে আলু চাষের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আদ্রতা কম থাকলেও, গাছ মরে যাওয়ার ফলে আলুগুলি পরিণত হওয়ার যুযোগ পায়নি। যেখানে ৪০-৪৮ দিনের প্রয়োজন সেখানে শুধু মাত্র ২০-২২ দিন সময় পাওয়া গিয়েছে। সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। এ ফলে আলুর আকার যথেষ্ট ছোট হয়েছে এবং খোসাও খুবই পাতলা। এখন ৫০ শতাংশ আলু পাওয়া গেলেও সংরক্ষণের সমস্যা তাই থাকছে বলে আশাঙ্কা কৃষি দফতরের আধিকারিক ও চাষিদের।