নাম শুনলেই লোকে চমকায়

এতদিন বাউলগান করতে গিয়ে, দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে নিজের বাড়ি শান্তিনিকেতন বলতেন শিল্পী বাসুদেব দাস। এলাকার শিক্ষক বিদ্যুত্‌ মণ্ডল, স্বপনকুমার ডোমরা যেমন বলতেন, শিলাজিতের গ্রামে তাঁদের বাড়ি। কিংবা আজমত খান, শেখ উজ্জ্বলদের মতো অনেকে বোলপুর-সিউড়ি রাস্তার ওপর তাঁদের ঠিকানা দিয়ে পরিচয় দিতেন।

Advertisement

মহেন্দ্র জেনা

পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২০
Share:

এতদিন বাউলগান করতে গিয়ে, দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে নিজের বাড়ি শান্তিনিকেতন বলতেন শিল্পী বাসুদেব দাস। এলাকার শিক্ষক বিদ্যুত্‌ মণ্ডল, স্বপনকুমার ডোমরা যেমন বলতেন, শিলাজিতের গ্রামে তাঁদের বাড়ি। কিংবা আজমত খান, শেখ উজ্জ্বলদের মতো অনেকে বোলপুর-সিউড়ি রাস্তার ওপর তাঁদের ঠিকানা দিয়ে পরিচয় দিতেন। এখন অবশ্য, এর কোনওটাই বলতে হয় না বাসুদেব, বিদ্যুত্‌ অথবা উজ্বলবাবুদের। এখন একটি শব্দেই উত্তর দেন তাঁরা। পাড়ুই!

Advertisement

কেন না, ঠিকানা ‘পাড়ুই’ বললেই যে লোকে চিনে যায়। শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য চোয়াল শক্ত করে ফেলেন। কারোও বা ভুরূ কুঁচকে যায়। আবার কেউ কেউ অতি উত্‌সাহে একের পর এক প্রশ্ন করতেই থাকেন! এখন কেমন আছে, আর বোমাবাজি হয়? গ্রামে হাওয়া কেমন- পুলিশ রয়েছে, এখনও? এমন নানা প্রশ্ন উড়ে আসে!

শুধু কী তাই? দিন এনে দিন খাওয়া পরিবার থেকে শুরু করে অবস্থাপন্ন পরিবার, পাড়ুই এলাকায় বিয়ে-শাদির জন্য পাত্র-পাত্রী দেখভালের ক্ষেত্রেও এখন ‘পাড়ুই’ শব্দের অপার মহিমা। পাকা দেখার পরও ভেঙে যাচ্ছে বিয়ে। গণ্ডগোলের গ্রামে কেই বা আত্মীয়তা করতে চায়!

Advertisement

পাড়ুই হাটতলা সংলগ্ন অজিত দাসের ছোট্ট হোটেলে বৈকালিক চায়ের ঠেকে বসে কথা হচ্ছিল স্থানীয়দের সঙ্গে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, এক বৃদ্ধের আর্তি, “আসলে কি জানেন, ঠিক পাড়ুইয়ে কিন্তু কোনও রকমের ঝামেলা, গণ্ডগোল হয়নি। সমস্ত দল-মত নির্বিশেষে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সকলে একে অপরের সঙ্গে ভীষণ সহমত পোষণ করে এখানে চলে। যেহেতু থানার নাম পাড়ুই, তাই পাড়ুই থেকে ১৮/২০ কিলোমিটার দূরের কোনও গ্রামে এলাকা দখলের লড়াই বা খুন-বোমাবাজি যাই হোক, টিভিতে দেখাতে শুরু করে পাড়ুই!’’

বৃদ্ধের আর্তি মিথ্যে নয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রচার পর্ব থেকেই জনপ্রিয় পাড়ুই। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে, দলীয় প্রার্থীদের প্রচার শেষের দু’ দিন আগের কথা। পাড়ুই থানার কসবাতে গিয়ে তৃণমূলের প্রচার সভায় পুলিশকে বোম মারার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। এবং তার পর পরেই নির্দল, বলা ভাল বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বাবা সাগর চন্দ্র ঘোষ খুন হন। ওই খুনের পর, কার্যত পাড়ুই থানা এলাকা রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে আলাদা জায়গা করে নেয়। ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা।

সে ঘটনা কখনও, এলাকায় বোমা আর অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে পাড়ুই থানার ওসি-সহ পুলিশ কর্মীদের আক্রান্তের অভিযোগ। কখনও বহিরাগত দুষ্কৃতী নিয়ে এসে গ্রাম দখলের মরিয়া চেষ্টা নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ। কখনও আবার, উভয় পক্ষের বোমা এবং গুলির লড়াইতে নিহত উভয় দলের একাধিক কর্মী-সমর্থক। সংবাদের শিরোনামে প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসে পাড়ুই। এতে, পত্র-পত্রিকা, সংবাদমাধ্যম, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আনাগোনা লেগেই রয়েছে পাড়ুই এলাকায়।

খবরের শিরোনামে যাই থাক, পাড়ুই আদতে জেলার চারটি ব্লকের দুটি করে পঞ্চায়েত নিয়ে একটি থানা এলাকা। এই ব্লকগুলির মধ্যে রয়েছে, সাঁইথিয়া ব্লকের দুটি পঞ্চায়েত, ইলামবাজার ব্লকের দুটি, বোলপুর ব্লকের দুটি এবং সিউড়ি দু’ নম্বর ব্লকের দুটি পঞ্চায়েত। এই গঞ্জ শহরে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, হাই মাদ্রাসা, থানা এবং বাজার উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পঞ্চায়েত কার্যালয়, সেচ দফতরের কার্যালয়, আর আই অফিস পর্যন্ত। রয়েছে এক্সপ্রেস অথবা, সুপার ফাস্ট বাসের স্টপেজও।

তবু, এলাকার রাজনৈতিক কোন্দলে পাড়ুই নামের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া ক্ষত যেন পিঠু ছাড়তে চায় না। সেই আক্ষেপই করছিলেন বাসের জন্য অপেক্ষারত সনাতন মণ্ডল। তাঁর মেয়ের বিয়ের জন্য প্রস্তাব এসেছিল। তিনি বলেন, “পাড়ুই এলাকার নাম শোনা মাত্রেই, পাত্র রাজি থাকলেও তাঁর পরিবার কোনও মতেই রাজি হননি। কলকাতা এবং অন্য জেলা থেকেও মাস চারেকের মধ্যে গোটা কুড়ি প্রস্তাব এসেছে মেয়ের জন্য। কিন্তু বাড়ি পাড়ুই বলে, ফিরিয়ে দিচ্ছেন সকলে!”

বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের কর্মী শওকত আলির আবার অভিজ্ঞতাই অন্য। শওকতের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বিয়োগে সান্তনা জানাতে পাড়ুই বাড়িতে হাজির হয়েছিল তার বন্ধু সমীর পাত্র। কিন্তু পাড়ুই নিয়ে এহেন শিরোনামের পর, সাম্প্রতিক অতীতে তার স্ত্রী বিয়োগের পর, এলাকায় অশান্তির জেরের সমীরকে আস্তে দেয়নি তাঁর পরিবার। শওকত আলি বলেন, “সমীর ফোনেই খবর নিয়েছে।” রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলই হোক, বা বিজেপির রাজনৈতিক ভিত শক্ত করার প্রক্রিয়া, পাড়ুইয়ের অশীতিপর বৃদ্ধা শশিবালা, এই প্রজন্মের জিন্নাতুন খাতুন- সকলেই চান পাড়ুই নামের গা থেকে রাজনীতির ক্ষত মুছে যাক। জেলার আর পাঁচটা গঞ্জ শহরের মতোই শান্তি ফিরুক এলাকায়। টেলিভিশনের পর্দায় ব্রেকিং নিউজ থেকে সরে যাক পাড়ুইয়ের নাম!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন