‘পুলিশ’ তকমা কাড়ায় ক্ষোভ জেলায়

প্রতিশ্রুতি মতো নিয়মিত কাজ মেলেনি। কাজ করে সময়মতো টাকাও মেলেনি। এই সব নানা অভিযোগকে ঘিরে রাজ্য সরকারের প্রতি একটা ক্ষোভ আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। এ বার ‘পুলিশ’ পরিচয়ও মুছে যাওয়ার পরে সরকার তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করল বলেই মনে করছেন বীরভূম জেলার ‘সিভিক পুলিশ’দের বড় অংশই। গোটা ঘটনায় তাঁরা অসম্মানিত এবং হতাশ বোধ করছেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪৩
Share:

বিভিন্ন দাবিতে মুর্শিদাবাদের জেলাশাসকের দফতরের সামনে সিভিক পুলিশদের অবস্থান। —ফাইল চিত্র

প্রতিশ্রুতি মতো নিয়মিত কাজ মেলেনি। কাজ করে সময়মতো টাকাও মেলেনি। এই সব নানা অভিযোগকে ঘিরে রাজ্য সরকারের প্রতি একটা ক্ষোভ আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল। এ বার ‘পুলিশ’ পরিচয়ও মুছে যাওয়ার পরে সরকার তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করল বলেই মনে করছেন বীরভূম জেলার ‘সিভিক পুলিশ’দের বড় অংশই। গোটা ঘটনায় তাঁরা অসম্মানিত এবং হতাশ বোধ করছেন।

Advertisement

দীর্ঘ দিন ধরে রাজ্যের সিভিক পুলিশেরা নিজেদের জন্য চারটি দাবি করে আসছেন। এক, নিয়োগ স্থায়ী করতে হবে। দুই, যত দিন তা না হয়, তত দিন সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। তিন, আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই-এর মতো সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে এবং চার, পুলিশের কাজে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু রাজ্য সরকার সে দাবি মানেনি। ওই দাবিকে ঘিরেই সংগঠন তৈরি করে গত ১০ জুলাই সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ারেরা কলকাতার রানি রাসমণি রোডে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। বস্তুত, সে দিনই তাঁরা প্রশাসনের ‘বিষ নজরে’ পড়ে যান বলে খবর। ‘পুলিশ’ লেখা ইউনিফর্ম পরে কোনও বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেওয়াটা রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা ভাল চোখে দেখেননি। এর পরেই ‘পুলিশ’ ছাঁটার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যায় নবান্নে। এই শব্দ বাদ যাওয়ায় ওই যুবকদের স্থায়ী চাকরির দাবি অনেকটাই লঘু হয়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রশাসনের কর্তারা।

মঙ্গলবার জেলার বিভিন্ন থানায় কর্মরত ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’দের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের নানা রকমের ক্ষোভের প্রতিক্রিয়াই উঠে এল। অনেকেই জানালেন, এত দিন ধরে ‘সিভিক পুলিশ’ পরিচয়েই জেলার পথ দুর্ঘটনা, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ, মেলা, খেলা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক মিটিং, মিছিল, সবেতেই তাঁরা সুমানের সঙ্গে দায়িত্ব সামলেছেন। “যারা এত দিন ধরে এই সব কিছু সামলে এল, তারা এখন থেকে শুধুই স্বেচ্ছাসেবক! এ কেমন বিচার? এটা প্রতারণা ছাড়া আর কি?”, বলছেন নলহাটির এক হতাশ সিভিক স্বেচ্ছাসেবক। অনেকেই আবার জানাচ্ছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হলেও কাজে যোগ নিযুক্ত হওয়ার পরে তাঁদের আশা ছিল ‘মা-মাটি-মানুষে’র এই সরকার একদিন ঠিক তাঁদের স্থায়ী পুলশ কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেবেন। স্বরাষ্ট্র দফতরের বিজ্ঞপ্তি তাঁদের সেই আশায় জল ঢেলেছে। পাশাপাশি কেউ কেউ ছাটাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাতেও ভুগতে শুরু করেছেন।

Advertisement

তবে, তাঁদের উপরে যে শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে তার একটা আঁচ সিভিক পুলিশরা কিছু দিন ধরেই পাচ্ছিলেন। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, কলকাতায় বিক্ষোভে সামিল হওয়ার পরেই রাজ্য থেকে জেলায় একটি নির্দেশ আসে। তাতে বিক্ষোভে সামিল হওয়া সিভিক পুলিশের তালিকা তৈরি করে পাঠানোর কথা বলা হয়। প্রতিটি থানার ওসিকে গোপনে এই রিপোর্ট পাঠাতে বলা হলেও সিভিক পুলিশের কাজে যুক্ত থাকা অনেকেই সেই খবর জানতে পেরে যান। তখন থেকেই আশঙ্কা শুরু হয়েছিল। নয়া নির্দেশিকার পরে তাঁদের আশঙ্কাই সত্যি হল। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সিউড়ির এক সিভিক ভলান্টিয়ার ক্ষোভের সুরে বলছেন, “থানা থেকে আমাদের পরিচয়পত্র ব্যবহার করতেও নিষেধ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তা হলে আমাদের কী তফাৎ রইল!” তাঁর অভিযোগ, এমনিতেই দূরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে থানা থেকে টর্চ বা গাড়ির তেলের খরচ, কিছুই মেলে না। মাসে অল্প যে ক’দিন কাজে মেলে, তার বেতনের জন্যও বহু দিন ধরে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে হয়।

সিভিক পুলিশ নিয়ে রাজ্য সরকারের এই মনোভাব দেখে অনেকেই নিজেদের ক্ষোভ লুকিয়ে রাখেননি। এক সিভিক পুলিশের কথায়, “প্রতিশ্রুতির পরেও সরকার অনেক কিছুই আমাদের দেয়নি। তার পরেও আশায় বুক বেঁধেছিলাম। হোক না নিয়মিত বেতন। সরকারি কাজ তো। আমাদের সকলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ঠিক ভাবে কাজে লাগানে হবে। সরকার সেই আশায় জল ঢেলে দিল।” তবে, সকলেই যে রাজ্য সরকারের প্রতি ক্ষোভ ব্যক্ত করছেন এমনটা নয়। অনেকে দুষছেন নিজেদেরও। তাঁরা বলছেন, “অস্থায়ী জেনেই তো কাজে যোগ দিয়েছিলাম। পুলিশের কাজে যুক্ত থেকে এ ভাবে আন্দোলনে নামা ঠিক হয়নি। কারও কারও হঠকারি সিদ্ধান্তের জন্যই সবাইকে ভুগতে হল।” আবার এ ভাবে পথে নেমে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোকে সমর্থন না করলেও আন্দোলনকারীদের দাবি ন্যায্য বলেই অনেকে মনে করছেন।

এমন নির্দেশে পুলিশ মহলের একটি অংশ অবশ্য খুশিই হয়েছেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের কিছু আধিকারিকদের দাবি, “প্রশিক্ষণহীণ এই বিপুল সংখ্যক যুবক-যুবতীদের স্রেফ রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে নিয়োগ করা হয়েছিল। তাঁদের দিয়ে পুলিশের তেমন কিছু উপকার হয়নি। কারণ, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় আইনের চোখে কোনটা অপরাধ আর কোনটা নয়, গত এক বছরেও তাঁদের একটি অংশকে সেটা বোঝানোই যায়নি। উপরন্তু ‘পুলিশ’ তকমা পেয়ে অনেকের মধ্যেই দাদাগিরির প্রবণতাও বেড়ে গিয়েছিল।” এমনকী, বোলপুর মহকুমা এলাকায় সিভিক পুলিশদের একাংশ তোলাবাজিও শুরু করেছেন বলে পুলিশ কর্তাদের কাছে অভিযোগ এসে পৌঁছেছিল। গা থেকে পুলিশের তকমাই সরে যাওয়ায় সিভিক পুলিশদের একাংশের ওই সব কর্মকাণ্ড এ বার বন্ধ হবে বলেই ওই পুলিশ কর্তাদের মত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন