বিরোধীদের গোল দিয়ে হঠাৎ কোর্টে

ফোনে খবরটা দিতেই কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে বসে আঁতকে উঠলেন বিজেপি-র সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন। বিস্ময় জড়ানো গলায় বললেন, ‘‘এ ভাবে হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকণ্ডলীর সদস্যও তখন নিজের জেলা অফিসে বসে। তাঁর অভিজ্ঞ মন্তব্য, “চিত্রনাট্য আগে থেকেই লেখা ছিল। এ দিন শুধু নাটকটা মঞ্চস্থ করা হল!” ছাপ্পাভোটে অভিযুক্ত তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার আত্মসমর্পণের খবর শুনে এমনই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মিলল জেলার দুই বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার মুখে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৫:১৬
Share:

জামিন মঞ্জুর। আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন দীপালি সাহা। সমর্থকদের দিকে হাত নাড়িয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল বিধায়কের গাড়ি।

ফোনে খবরটা দিতেই কলকাতায় দলীয় কার্যালয়ে বসে আঁতকে উঠলেন বিজেপি-র সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন। বিস্ময় জড়ানো গলায় বললেন, ‘‘এ ভাবে হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি!”

Advertisement

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকণ্ডলীর সদস্যও তখন নিজের জেলা অফিসে বসে। তাঁর অভিজ্ঞ মন্তব্য, “চিত্রনাট্য আগে থেকেই লেখা ছিল। এ দিন শুধু নাটকটা মঞ্চস্থ করা হল!” ছাপ্পাভোটে অভিযুক্ত তৃণমূল বিধায়ক দীপালি সাহার আত্মসমর্পণের খবর শুনে এমনই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া মিলল জেলার দুই বিরোধী দলের শীর্ষ নেতার মুখে।

গত ৭ মে-র পর থেকে প্রায় দেড়মাস ধরে এই দিনটির অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলগুলির জেলা নেতারা। পুলিশ যে তাঁকে ধরবে না তা কার্যত নিশ্চিত ছিলই। তবুও ‘দীপালিকে গ্রেফতার করতে হবে’ বলে স্লোগান দিয়ে একের পর এক আন্দোলনে নেমে শক্তি প্রদর্শন করেছে বিজেপি। বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে মুখ খুলে ঘটনার সমালোচনা করে কর্মীদের কাছে বাহবা কুড়িয়েছেন সিপিএম নেতারাও। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নিদেন পক্ষে জামিন আটকাতে হবে। কিন্তু সোমবার সরকারি আইনজীবী ও বিজেপি-র আইনজীবী সেলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কার্যত ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে জামিন পেয়ে শেষ হাসি হাসলেন দীপালিদেবী, থুড়ি মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

কোর্ট চত্বরে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ভিড়।

রাজ্যে চতুর্থ দফার ভোটে সোনামুখীর সাহাপুর বুথে দলবল নিয়ে ঢুকে ভোট কর্মীদের মারধর করে ছাপ্পাভোট করার অভিযোগ ওঠে সোনামুখীর বিধায়ক দীপালির বিরুদ্ধে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার-সহ অন্য ভোট কর্মীরা সেই রাতেই থানায় দীপালিদেবীর বিরুদ্ধে একাধিক জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথম দফায় পুলিশ ১০ জনকে ও পরে আরও এক দীপালি ঘনিষ্ঠকে গ্রেফতার করে। ‘ফেরার’ বলে ঘোষণা করা হয় দীপালিকে। ঘটনায় ধৃত ১১ জনই কমপক্ষে ১৪ দিন জেল খেটে জামিন পেয়েছেন। অন্য দিকে, দীপালিকে ফেরার ঘোষণার পর থেকেই বিরোধীদের তোপের মুখে পড়ে পুলিশ। হাতের নাগালে পেয়েও শাসকদলের প্রতিনিধি হওয়াতেই তাঁকে ধরা হচ্ছে না বলে অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। তাঁকে ধরার দাবিতে শতাধিক বিজেপি কর্মী ডিএম অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়ে স্মারকলিপিও দেন। যদিও বিরোধীদের এই অভিযোগ উড়িয়ে জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার দাবি করেছিলেন, “দীপালিদেবী ফেরার। আমরা তাঁর খোঁজ চালাচ্ছি। কিন্তু কোনও হদিস পাচ্ছি না।”

এ দিন দীপালির আত্মসমর্পণের পরে দু’টি প্রশ্ন তুলছে বিজেপি ও সিপিএম। প্রথমত, অভিযোগ পত্রে শুধুমাত্র দীপালির নাম ছিল। অথচ এর আগে সন্দেহের বশে যাদের ধরা হয়েছে অভিযোগপত্রে তাঁদের নাম না থাকলেও তাঁরা প্রথমে জামিন পাননি। কিন্তু মূল অভিযুক্ত দীপালি জামিন পেলেন কী ভাবে? দ্বিতীয়ত, পুলিশ ফেরার জানিয়ে দীপালিকে গ্রেফতার করেনি। অথচ রাজ্যের মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায় এ দিন প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, দীপালি অসুস্থ অবস্থায় এতদিন বাড়িতেই ছিলেন! কোনটা সত্যি?

অমিয়বাবু বলেন, “দীপালি ফেরার বলে পুলিশ আমাদের জানিয়েছিল। কিন্তু দলের মন্ত্রী বলছেন তিনি বাড়িতেই ছিলেন। দুটি পরস্পর বিরোধী কথা। কোনটা ঠিক তা সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার করা উচিত।” কংগ্রেসের জেলা সভাপতি রাধারাণি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এমনটা হতে থাকলে রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার উপরে মানুষের আস্থা হারিয়ে যাবে।” পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারের সঙ্গে অবশ্য চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। বিজেপি-র সুভাষবাবু বলেন, “জেলায় ফিরেই আমি বিষ্ণুপুর আদালত থেকে জামিনের প্রতিলিপি সংগ্রহ করব। তারপর এ বিষয়ে আগামী পদক্ষেপ ঠিক করব।”

দীপালি ইস্যুতে শুধু মাত্র শাসকদল তৃণমূলই নয়, ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে জোরালো আন্দোলনে না নামায় পরোক্ষ ভাবে চাপে পড়েছে সিপিএমও। দলের অন্দরেই এক শ্রেণির কর্মীরা এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। কয়েকবছর আগে সোনামুখী পুরসভায় অনাস্থা সংক্রান্ত ভোটাভুটিতে সিপিএমের পুরসভার ক্ষমতা ধরে রাখার কারণ ছিলেন এই দীপালি। এমনটাই দাবি করেন দীপালির বিক্ষুদ্ধেরা। সেই ঘটনার জন্য দীপালির প্রতি সিপিএমের কিছু নেতা ‘নরম’ বলে অভিযোগ তুলেছে বিপেজি।

সোনামুখীর তৃণমূল নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দলীয় বিধায়ক দীপালির গোষ্ঠী কোন্দলের ঘটনা একাধিক বার প্রকাশ্যে এসেছে। দু’জনেই সোনামুখী পুরসভার কাউন্সিলর পদে রয়েছেন। কয়েক বছর আগে এই পুরসভায় সিপিএম পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন সুরজিৎবাবু। কিন্তু একটি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা দীপালির একটি ভোটেই সিপিএমের বোর্ড টিকে যায়। এই নিয়ে ভোটাভুটির দিনেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বেঝেছিল। এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে সুভাষবাবু বলেন, “দীপালি-কাণ্ডে আগাগোড়া চুপ করে থেকেছে সিপিএম। আন্দোলনে না গিয়ে অনাস্থা ভোটে দীপালির দেওয়া ভোটের ঋণই শোধ করল ওরা। দীপালি যতটা তৃণমূলের, ততটাই সিপিএমেরও।”

যদিও সুভাষবাবুর এই অভিযোগ মানতে নারাজ অমিয়বাবু। তাঁর বক্তব্য, “আমরা আন্দোলনে নামিনি, এ কথা ঠিক নয়। দীপালি-কাণ্ডের পরে আমরা পথসভা করে এই ঘটনার বিরোধিতা করেছি। তাঁকে গ্রেফতারের দাবিতে স্মারকলিপিও দিয়েছি। বিজেপি-র এই সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।”

ছবি: শুভ্র মিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন