মুখোমুখি বামপ্রার্থী নরহরি মাহাতো ও তৃণমূলের মৃগাঙ্ক মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো
দেওয়াল থেকে মাইক ভোট প্রচারে নেতা-কর্মীদের তর্জন-গর্জন পুরোমাত্রায় চলছে। তার মধ্যে বিপক্ষের বিরুদ্ধে কটূক্তি করেও কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের ‘শো-কজ’ চিঠি পেয়েছেন। এই আবহেই বুধবার মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় বিরল রাজনৈতিক সৌজন্যের নজির দেখল পুরুলিয়া জেলাশাসকের দফতর।
এ দিন ঘটনাচক্রে বামফ্রন্ট, তৃণমূল, বিজেপি ও এসইউসি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন। তাঁদের অনেকের মধ্যে দেখাও হয়ে গেল। কারও কারও মধ্যে তা শুধুই চোখাচোখি সঙ্গে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল। কেউ আবার বুকে হাত জড়ো করে বিপক্ষের প্রার্থীকে সৌজন্যমূলক নমস্কার করলেন।
এ দিন প্রথমে মনোনয়ন জমা দিতে আসেন তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতো। সঙ্গে ছিলেন বিধায়ক কে পি সিংহদেও, জেলা পরিষদ সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো, পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো সঙ্গে এলেও তিনি অবশ্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে হলঘরে ঢোকেননি। মৃগাঙ্কবাবুর নথিপত্র যাচাই করছিলেন কর্মীরা। হঠাৎ সেখানে ঢুকলেন বামফ্রন্ট প্রার্থী নরহরি মাহাতো, সঙ্গে জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক মণীন্দ্র গোপ, ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সভাপতি নিশিকান্ত মেহেতা, সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য কৃষ্ণপদ বিশ্বাস। চোখাচোখি হতেই কে পি সিংহদেও বললেন, “সকলকে আমার নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। করমর্দন করে তাঁর পাশের চেয়ারে বসলেন কৃষ্ণপদবাবু। বামফ্রন্টের প্রার্থী নরহরি মাহাতোও এগিয়ে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। একটু দূরে থাকায় মণীন্দ্রবাবু হাত নেড়েই শুভেচ্ছা জানালেন। ডিম্বাকৃতি টেবিলের উল্টোদিকে বসে থাকায় একই ভাবে হাত নেড়ে সকলকে শুভেচ্ছা জানালেন মৃগাঙ্কবাবুও। প্রশাসনের এক কর্মী বললেন, “চারপাশে নেতা-নেতায় যা বাক্যবাণ বর্ষণ হচ্ছে, তার মধ্যে এমন ফ্রেমে বাঁধানো মূর্হূত তো সহজে দেখা যায় না।”
সৌজন্যের মুর্হূত আরও কিছু উপহার পেলেন তাঁরা। টেবিলে জলের বোতল রাখা হলেও প্রচন্ড গরমে নিমেষে খালি হয়ে যাচ্ছিল। একটা বোতল তুলে জল খেতে গিয়ে কৃষ্ণপদবাবু দেখেন, বোতলে তলানিটুকু পড়ে আছে। তা দেখতে পেয়ে তৃণমূলের উপপুরপ্রধান (পুরুলিয়া পুরসভা) সামিমদাদ খান মৃগাঙ্কর পাশ থেকে উঠে এগিয়ে দিলেন অন্য একটি জলের বোতল। তারপর বললেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও আমাদের এই সৌজন্যতাটুকু রয়েছে।” মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলেন জেলার রাজনৈতিক ময়দানের নতুন সদস্য মৃগাঙ্কবাবুও।
রসিকতাও বাদ থাকল না। কাগজপত্রের পরীক্ষা শেষ হওয়ার মুখে কে পি সিংহ দেও-র সরস মন্তব্য, “এখন আমাদের ওয়েটিং চলছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি কনফার্মড হয়ে যাবে।” বামফ্রন্টের নেতাদের উদ্দেশ্য বললেন, “তারপর আপনাদের পালা! কি মণীন্দ্রবাবু?” তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মণীন্দ্রবাবু বলে উঠেলেন, “আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন?” কে পি সিংহদেও বললেন, “আপনি মধ্যমণি, তাই।” মৃদু হেসে মণীন্দ্রবাবুর জবাব, “সেটা ঠিক। মধ্যমণি কি না জানি না তবে মণি। কাগজপত্র দেখার পালা শেষ হওয়ার পরে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মুখে মণীন্দ্রবাবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন সৃষ্টিধরবাবু। দু’জনেই বলরামপুর এলাকার বাসিন্দা। ময়দানে দু’পক্ষের দ্বৈরথের কথা শুধু বলরামপুরই নয়, জানেন জেলাবাসীও। সৃষ্টিধরবাবুর কথার জবাবে মণীন্দ্রবাবু বললেন, “শুভকামনা করছ!” সৃষ্টিধরবাবুর পাল্টা প্রশ্ন, “কেন করব না?” হেসে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
তৃণমূলের নেতারা বেরিয়ে যেতে হল ঘরে ঢুকলেন বিজেপি প্রার্থী বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গে জেলার বর্ষীয়ান নেতা বি পি সিংহদেও। মুখোমুখি পড়ে গেলেন মণীন্দ্রবাবু। বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা জানতে চাইলেন, “কেমন আছেন?” মণীন্দ্রবাবুও হাসিমুখে বললেন, “ভাল।” পাশেই ছিলেন নরহরিবাবু। একই ভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় হল তাঁর সঙ্গেও। ফের দুই দলের নেতৃত্বের দেখা জেলাশাসকের চেম্বারে। বি পি সিংহদেও তাঁর দলের প্রার্থী বিকাশবাবুর সঙ্গে বিদায়ী সাংসদ নরহরিবাবুর পরিচয় করিয়ে দেন। নরহরিবাবু বললেন, “ভোটে হারজিত তো আছেই। একজনই জিতবেন। কিন্তু আমাদের রাজনীতি করতে হবে এখানেই।” মনোনয়নপত্র জমা দেন এসইউসি প্রার্থী সুবর্ণ কুমারও।