শহর না গ্রামের রাস্তা, ক্ষোভ পুরুলিয়ায়

প্রশ্নটা শুনেই বিস্তর চটে গেলেন গণেশ মাহাতো। প্রশ্নটা খুব খটমট কিন্তু ছিল না। জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই রাস্তা দিয়ে ভ্যানরিকশা চালাতে কি অসুবিধা হয়? ক্ষোভে গজগজ করতে করতে বললেন, “রাস্তার হাল দেখেও এই প্রশ্ন করছেন! এই রাস্তা দিয়েই আমাকে প্রতিদিন ভ্যানরিকশা নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। কোমর ব্যথা হয়ে যায়। দেখছেন না, রাস্তার উপরে বড়বড় গর্ত!”

Advertisement

প্রশান্ত পাল

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৪ ০১:৩৯
Share:

বেহাল রাস্তা। মানভূম ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে পুলিশ লাইন যাওয়ার পথ। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশ্নটা শুনেই বিস্তর চটে গেলেন গণেশ মাহাতো।

Advertisement

প্রশ্নটা খুব খটমট কিন্তু ছিল না। জানতে চাওয়া হয়েছিল, এই রাস্তা দিয়ে ভ্যানরিকশা চালাতে কি অসুবিধা হয়? ক্ষোভে গজগজ করতে করতে বললেন, “রাস্তার হাল দেখেও এই প্রশ্ন করছেন! এই রাস্তা দিয়েই আমাকে প্রতিদিন ভ্যানরিকশা নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। কোমর ব্যথা হয়ে যায়। দেখছেন না, রাস্তার উপরে বড়বড় গর্ত!”

গণেশবাবু পুরুলিয়া শহরের বেলগুমা এলাকার একটি ডেয়ারি ফার্মের কর্মী। যে রাস্তার কথা এই দুধের ক্যানবাহক বলছিলেন, সেটি হল শহরের ভিক্টোরিয়া স্কুল মোড় থেকে ভাটবাঁধ মোড় পর্যন্ত। পুরসভার খাতায় যে রাস্তার পোশাকি নাম মিশন রোড। এই রাস্তা দিয়ে যাঁরা নিত্য যাতায়াত করেন, তাঁরাই জানেন, এ রাস্তার কী ‘মহিমা’! এ রকমই আর এক রাস্তায় চলার অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন সুদীপ্ত চক্রবর্তী। মাঝে পুরুলিয়ায় কাজে এসেছিলেন বাঁকুড়া শহরের বাসিন্দা সুদীপ্তবাবু। ট্রেন ধরবেন বলে দুপুরে জেলাশাসকের দফতরের সামনে থেকে রিকশায় উঠেছিলেন। গন্তব্য, পুরুলিয়া স্টেশন। হাটের মোড় হয়ে স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা দিয়ে রিকশা চালক নিয়ে যাচ্ছেন। আর সুদীপ্তবাবু সমানে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে। রিকশা চালক বিরক্ত হয়ে বলছেন, “এই রাস্তা দিয়ে কি তাড়াতাড়ি চালানো যায় দাদা? দেখছেন তো অবস্থা।” শেষমেশ স্টেশনে যখন নামলেন সুদীপ্তবাবু, দেখলেন ট্রেন বেরিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

বস্তুত, শুধু পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দারেই নয়, বাইরের মানুষজন, নিত্য কাজকর্মে যাঁদের এ শহরে যাতায়াত করতে হয়, তাঁদেরও বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে এ শহরের রাস্তা নিয়ে। ভিক্টোরিয়া স্কুল মোড় থেকে ভাটবাঁধ মোড়, ডিএম অফিসের সামনের রাস্তা, হাটের মোড়ের রাস্তা, জগন্নাথ কিশোর কলেজ রোড, সাধুডাঙা রোড, নর্থলেক রোড (ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সামনের রাস্তা)-সহ বিভিন্ন পাড়ার রাস্তা নিয়েও শহরবাসীর অসন্তোষ ও ক্ষোভ এখন আর গোপন নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করা যায় না। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, “এই সব রাস্তা কখনও একটা পুর-শহরের হতে পারে? আসলে পুরসভার রাস্তাঘাট নিয়ে কোনও মাথাব্যথাই নেই। পুরকর্তাদের তো আর এই সব রাস্তা দিয়ে চলতে হয় না! তাই তাঁরা রাস্তাঘাটের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামান না।”

শহরে কান পাতলেই এমন নানা মন্তব্য কানে আসে। শহরের শশধর গঙ্গোপাধ্যায় রোডের বাসিন্দা অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “বিভিন্ন রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, তা আর বলার নয়। অধিকাংশ রাস্তাই খন্দে ভরা। রিকশা করে যাওয়াও অসুবিধের। পুরসভার কি আদৌ রাস্তাঘাটের দিকে নজর রয়েছে?” মানভূম ভিক্টোরিয়া ইন্সস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক রাজেশ দরিপা বলছিলেন, “পুরুলিয়ার মতো এত প্রাচীন একটা পুরসভা। অথচ তার রাস্তাঘাটের এমন হতশ্রী অবস্থা অবস্থা দেখলে খুব খারাপ লাগে। বিভিন্ন রাস্তায় বড় বড় গর্ত। আর সামান্য বৃষ্টিতেই সেই গর্তে জল জমে ভয়ঙ্কর অবস্থা। পুরসভার নজর দেওয়া দরকার।” রাস্তা নিয়ে জানতে চাওয়ায় শহরের বই ব্যবসায়ী অসীম করের প্রতিক্রিয়া, “রাস্তা নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভাল। বৃষ্টি হলে রাস্তার অসংখ্য গর্তে জল জমে যায়। আর অন্য সময়ে রাস্তায় এত ধুলো যে একটা গাড়ি পেরিয়ে গেলে দোকানের সামনে কেউ বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেন না। শহরের না গ্রামের রাস্তা, তফাত থাকে না। এই অবস্থার মধ্যেই আমাদের ব্যবসা করতে হয়।” চিত্তরঞ্জন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মৌলিশ্রী দাস বলেন, “আমাদের স্কুলের সামনের রাস্তার কথাই ধরুন। কয়েক মিটার ছাড়া ছাড়া গর্ত। পুরসভার তো এ দিকে নজর দেওয়া দরকার।”

পুরুলিয়া পুরসভার বিরোধী দলনেতা, কংগ্রেসের বিভাস দাসের বক্তব্য, “বেহাল রাস্তার প্রসঙ্গ আমরা বিভিন্ন বৈঠকে পুরপ্রধানকে বলছি। কিন্তু, কে শোনে কার কথা! বারবার বলে দু-একটি রাস্তায় কাজ হয়েছে। বেশির ভাগ রাস্তার অবস্থাই শোচনীয়। রাস্তাঘাটের সংস্কার যে পুরসভাকে করতে হবে, এই বিষয়টি তৃণমূল পরিচালিত পুর-কর্তৃপক্ষ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। আর দিনে দিনে ক্ষোভ বাড়ছে শহরবাসীর।” শুধু বিরোধীরাই নন, শহরের রাস্তার হাল নিয়ে নিজের ক্ষোভ গোপন রাখেননি এমনকী খোদ পুরুলিয়ার উপপুরপ্রধান, তৃণমূলের শামিমদাদ খানও। তিনি বলেছেন, “রাস্তার সংস্কার খুব জরুরি। কিন্তু, পুরসভা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকে, কী করতে পারি!”

কিন্তু, সারানোর দায়িত্ব তো আপনাদেরই? সামিমদাদের জবাব, “এ প্রশ্নের উত্তর পুরপ্রধানই দিতে পারবেন।” প্রসঙ্গত, দলেরই পুরসভার কাজকর্ম নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন পুরুলিয়ার উপপুরপ্রধান। পুরপ্রধানের নাম না করে তাঁর কাজকর্মের কিছু নমুনা তুলে ধরেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ওই সমস্ত কাজকর্ম কি স্বৈরাচারের নমুনা নয়, সাইটে এমন সব প্রশ্নও তুলে ধরেছেন তিনি।

পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাস্তার কাজ আমরা করব। কিন্তু, কয়েকটি রাস্তা আমরা পূর্ত দফতরকে অধিগ্রহণ করতে অনুরোধ করেছি। কেননা শহর দিনে দিনে বাড়ছে। আমাদের আওতায় থাকা রাস্তাঘাটও বাড়ছে। তাই শহরের মধ্যে প্রধান কয়েকটি রাস্তা পূর্ত দফতর নিয়ে নিলে পুরসভার পক্ষে সুবিধে হবে। এই মর্মে জেলা প্রশাসনকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কথাবার্তা চলছে। এই সিদ্ধান্ত হয়ে গেলেই রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু করব।” পূর্ত দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তরুণকুমার চক্রবর্তী বলেন, “এটা ঠিক যে, পুরুলিয়া শহরের কয়েকটি রাস্তা পূর্ত দফতর অধিগ্রহণ করবে। হস্তান্তরের কাজ কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে আশা করছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন