সুগন্ধী ধান চাষে লাভের মুখ দেখছে খয়রাশোল

উদ্দেশ্যে ছিল প্রথাগত ধান চাষের একঘেয়েমি কাটানো এবং ধান চাষেই কৃষকদের আরও বেশি লাভের মুখ দেখানো। সেই ভাবনা থেকেই গত বছর সুগন্ধী চাষের এলাকা বিস্তার ও বীজ উৎপাদন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কৃষি দফতর খয়রাশোলের একটি অংশে শুরু করেছিল সুগন্ধী ধান গোবিন্দভোগ ও বাদশাভোগের বাণিজ্যিক চাষ। লাভের মুখ দেখে এ বার ফের সুগন্ধী ধান চাষে সাড়া মিলল খয়রাশোলে। চাষের পরিমান বেড়ে গিয়েছে পাঁচগুন!

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৪ ০০:৪২
Share:

সুগন্ধী ধানজমি পরিচর্যা করছেন চাষিরা। —নিজস্ব চিত্র

উদ্দেশ্যে ছিল প্রথাগত ধান চাষের একঘেয়েমি কাটানো এবং ধান চাষেই কৃষকদের আরও বেশি লাভের মুখ দেখানো। সেই ভাবনা থেকেই গত বছর সুগন্ধী চাষের এলাকা বিস্তার ও বীজ উৎপাদন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কৃষি দফতর খয়রাশোলের একটি অংশে শুরু করেছিল সুগন্ধী ধান গোবিন্দভোগ ও বাদশাভোগের বাণিজ্যিক চাষ। লাভের মুখ দেখে এ বার ফের সুগন্ধী ধান চাষে সাড়া মিলল খয়রাশোলে। চাষের পরিমান বেড়ে গিয়েছে পাঁচগুন!

Advertisement

কৃষি দফতরের পরামর্শ ও সহযোগিতায় গত বছরই সসম্মানে উতরে গিয়েছিলেন এলাকার চাষিরা। তাঁরা ফলনের দামও পেয়েছিলেন অশানরূপ। সেই উপলব্ধি ও উৎসাহে ভরসা করে এবার ফের সুগন্ধী ধান চাষে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে খয়রাশোলে। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে খবর, সুগন্ধী ধান চাষের পরিমান এবার বেড়ে গিয়েছে পাঁচগুন। ধান চারা রোঁয়ার কাজ শেষ। মাঠ জুড়ে সুবজ আভা। খয়রাশোলের শিরা, বিনোদপুর, ভবানীগঞ্জ, পলপাই, সারসা, বড়রার মত গ্রামের বিস্তৃর্ণ ধান খেতের পাশ দিয়ে গেলেই পরিচিত সুবাস নাকে আসবে এখন থেকেই।

কৃষি দফতর সূত্রের খবর, গতবার জেলায় একমাত্র খয়রাশোলের বিনোদপুর, শিরা, পলপাই এবং ভবানীগঞ্জ এই চারটি গ্রামের মোট ৮৪ জন চাষি পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে ওই সুগন্ধী ধানের চাষ করেছিলেন। সরকারি ভাবে এবার ৩২০ জন চাষিকে বীজ দেওয়া হয়েছে। তারপরও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু চাষি তাঁদের জমিতে বাদশাভোগ ও গোবিন্দভোগের চাষ করছেন। মোট সুগন্ধী ধানের চাষ হচ্ছে ২৫০ হেক্টর জমিতে। বিনোদপুর, পলপাই, শিরা ভবানীগঞ্জ ছাড়াও এলাকার খয়রাশোলের কাঁকরতলা বড়রা, হজরতপুর, সারসা, কেন্দ্রগড়িয়া, রসিদপুর-সহ বিভিন্ন গ্রামে সুগন্ধী ধান চাষ হচ্ছে। জেলা উপ অধিকর্তা কৃষি(প্রাশাসন) প্রদীপ কুমার মণ্ডল বলেন, “খয়রাশোলের সাফল্যকে মডেল করে ভাবিষ্যতে এই চাষকে জেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনাও রয়েছে আমাদের।”

Advertisement

যে প্রশ্নটা সঙ্গত ভাবে আসে সেটা হল কী কারণে সুগন্ধী ধান চাষকে বানিজ্যিক ভাবে করার জন্য শুধু খয়রাশোলকেই বাছা হল? এলাকার চাষিরা অবশ্য এর সব কৃতিত্ব দিতে চান ব্লক কৃষি আধিকারিক দেবব্রত আচার্যকে। কেন না, স্থানীয় চাষিরা বলছেন, ২০১১ সালে খয়রাশোলের শাল ও হিংলো নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে থাকা পলপাই গ্রামের এক চাষি তাঁর নিজের জমিতে চাষ করা সামান্য পরিমান গোবিন্দভোগ চাল এনে খয়রাশোল ব্লকের সহ কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্যকে পায়েস করে খেয়ে দেখার জন্য দিয়েছিলেন। বিষয়টির সূত্রপাত তখন থেকেই। গোবিন্দভোগ হাতে পাওয়ার পর চালের মান দেখে ভিন্ন ধরনের ভাবনা মাথায় এসে যায় ওই আধিকারিকের। তিনি খতিয়ে দেখতেই এলাকায় গিয়ে গোবিন্দভোগ ধানের চাষ কী ভাবে করেন চাষিরা সে বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করেন। খয়রাশোল ব্লকের কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলেন, “ওই চারটি গ্রামের চাষিদের সঙ্গে কথা বলার পর জানতে পারি, প্রথাগত ভাবে (রাসায়নিক সার ব্যবহার করে) বহুবছর ধরে খুব কম পরিমান জমিতে এবং বাড়ির প্রয়োজনে এই চাষ করছেন কয়েকজন চাষি।”

একথা জানার পর প্রথমেই একটি ফামার্স পেরডিউসার গ্রুপ তৈরি করতে বলেন তিনি। তার পর কোথাও শ্রী পদ্ধতি অবলম্বন করে, কোথাও বা প্রথাগত ভাবে (মূলত জৈব পদ্ধতিতে) কিছুটা বেশি পরিমান জমিতে গোবিন্দভোগ পরামর্শ দেন উৎসাহী চাষিদের। এবং তিনি ভালো ফলও পান। খুব ভাল ফলন হয় গোবিন্দভোগেরই। ওই এলাকায় উৎপাদিত চাল কৃষি বিপণন দফতরে পাঠিয়ে গুনগত মানও যাচাই করা হয়েছিল। দফতর শিলমোহর দিয়েছিল। তারপর থেকেই বিষয়টি এগিয়েছে। গত বছর বিশেষজ্ঞরা এসে চাষিদের সুগন্ধী ধান চাষে প্রশিক্ষণের একটা শিবিরও করিয়েছিলেন খয়রাশোলে।

“আমরা কেউ ১০ বিঘা, কেউ ১২ বিঘা জমিতে এই চাষ করে ছিলাম। স্বল্প বৃষ্টিতে প্রতি বিঘায়
তিন ক্যুইন্টাল পর্যন্ত ধান পেয়েছিলাম। দাম পেয়েছিলাম ক্যুইন্টাল প্রতি ৩০০০ টাকা।”

পলপাই গ্রামের চাষি আভিজিৎ ঘোষ, বিনোদপুর গ্রামের তপন লাহা।

এ ব্যপারে চাষিদের কী মত? যাঁরা আগের বারে এই চাষ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে পলপাই গ্রামের চাষি আভিজিত ঘোষ, বিনোদপুর গ্রামের চাষি তপন লাহা, বিনোদপুরের কালী শঙ্কর ঘোষেরা বলছেন, “আমরা কেউ ১০ বিঘা, কেউ ১২ বিঘা জমিতে গোবিন্দভোগ চাষ করেছিলাম। স্বল্প বৃষ্টিতে প্রতি বিঘায় তিন ক্যুইন্টাল পর্যন্ত ধান পেয়েছিলাম। এবং ধানের দাম পেয়েছিলাম ক্যুইন্টাল প্রতি ৩০০০ টাকা। পাশের জেলা বর্ধমান থকে গাড়ি করে সেই ধান কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন ধান ব্যবসায়ীরা।”

প্রথাগত ধান(স্বর্ণ)চাষ করে ক্যুইন্টাল প্রতি ১১০০-১২০০ টাকার বেশি মিলত না, সেখানে এখন লাভের মুখ দেখছেন চাষিরা। এবারই নিজের ১২ বিঘা জমিতে প্রথমবার বাদশাভোগ চাষ করলেন সারসা গ্রামের প্রদীপ ঘোষ। বলছেন, “গতবার যাঁরা এ চাষ করেছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত। আশা করি ফল ভাল হবে।”

এ দিন নিজের জমিতে নিড়ান দেওয়ার কাজ দেখভাল করছিলেন। তার ফাঁকেই বলেন, “নিজেই কেচো সার প্রস্তুত করি। কৃষি দফতরের পরামর্শ মেনে রাসায়নিক সারের বদলে সেটাই প্রয়োগ করেছি। যাতে চালে গন্ধ ঠিকমত থাকে।”

এ দিকে অশঙ্কার কথাও বলছেন চাষিদের একাংশ। আশঙ্কা, ধানের শীষ আসার সময় মাজরা পোকার আক্রমণের সমস্যা থাকে। কৃষি দফতরের আধিকারিকেরা অবশ্য বলেছেন, সেই সময়টায় সতর্কতা অবলম্বন করলে ভয়ের কিছু নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন