করের টাকা খরচ করে কেন রিয়েলিটি শো, উঠছে প্রশ্ন

বিচারকদের দেওয়া নম্বরের মাপকাঠিতে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গিয়ে ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছে গাইয়ে বা শেষ মুহূর্তে প্রতিযোগিতায় টিঁকে হাত তুলে উল্লাস প্রতিযোগীর— টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোয়ের দৌলতে এই ছবি এখন ঘরে ঘরে পরিচিত।

Advertisement

দেবজিৎ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

বিচারকদের দেওয়া নম্বরের মাপকাঠিতে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গিয়ে ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছে গাইয়ে বা শেষ মুহূর্তে প্রতিযোগিতায় টিঁকে হাত তুলে উল্লাস প্রতিযোগীর— টেলিভিশনের রিয়েলিটি শোয়ের দৌলতে এই ছবি এখন ঘরে ঘরে পরিচিত। আর রিয়েলিটি শোয়ের এমন জমকালো ছবিটাই মনে ধরেছে নবান্নের। তাই শিল্পে বিনিয়োগ টানতে এ বার রিয়েলিটি শোকেই অস্ত্র করতে চাইছে রাজ্য সরকার। রবিবার ফেসবুকে শোয়ের কথা নিজেই জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

মমতা লিখেছেন, ‘বাংলা আবার প্রথম হওয়ার দোরগোড়ায়। টেলিভিশনে ‘এগিয়ে বাংলা’ নামে একটি বাণিজ্যিক রিয়েলিটি শো উপস্থাপনা করবে সরকার। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুব শিল্পদ্যোগীরা তাঁদের সাফল্যের কাহিনি জানানোর সুযোগ পাবেন এবং সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সরকার সহযোগিতা করবে। আমাদের প্রিয় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় হবেন এর মুখ। মাঠের ভিতরে ও বাইরে তাঁর যেমন আবেগ দেখেছি আমরা, সেই আবেগ দিয়েই সৌরভ শিল্পজগতের তরুণ প্রজন্মকে উস্কে দিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস’। আপাতত ঠিক আছে, একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলে নভেম্বর থেকে ২৬টি এপিসোডে সপ্তাহে দু’দিন (শনি ও রবি) ওই অনুষ্ঠান দেখানো হবে।

নবান্নের খবর, মাস তিনেক আগে এমন শো করার পরিকল্পনা প্রশাসনের শীর্ষমহলকে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কী ভাবে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়, সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁরই হাতে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরকে (এমএসএমই)। অনুষ্ঠানের ‘থিম সং’-ও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল— এ রাজ্যের ছোট ও মাঝারি শিল্পদ্যোগীরা কী ভাবে তাঁদের ব্যবসা বাড়াচ্ছেন, সরকার কী ভাবে তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, সরকারি উদ্যোগে টেলিভিশনে রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে আমজনতাকে সে কথাই জানাবেন শিল্পপতিরা। কিন্তু এমন অনুষ্ঠান পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা বা পরিকাঠামো কোনওটাই নেই সরকারের। তাই ওই শোয়ের রূপরেখা ঠিক করতে অভিজ্ঞ সংস্থার খোঁজে ইতিমধ্যে দরপত্র হেঁকেছে এমএসএমই। নবান্নের খবর, এই অনুষ্ঠানকে কী ভাবে আকর্ষণীয় করা যায়, তা নিয়েও কলকাতার একটি সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে তারা।

Advertisement

আর সরকারের এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নবান্নের অন্দরেই। শিল্প টানতে সরকারি অর্থে রিয়েলিটি শো করা নিয়ে ক্ষোভ চেপে রাখেননি অনেকেই। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী নিজে চেয়েছেন, তাই নানা যুক্তি দিয়ে এই অনুষ্ঠানটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে মরিয়া এমএসএমই। রাজ্যের শিল্পচিত্র যেখানে বিবর্ণই বলা যায়, সেখানে করের টাকায় এ সব করে কী লাভ, সে প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা। প্রশাসনের একাংশ বলছেন, সরকারি উদ্যোগে মেলা-খেলা-উৎসব এই আমলের গোড়া থেকেই শুরু হয়েছে। করের টাকায় মাটি উৎসব, জঙ্গলমহল উৎসব, প্রতি বার রাজ্য জুড়ে সরকারের বর্ষপূর্তি পালন, ভূষণ-বিভূষণের মতো গাদাগাদা পুরস্কার বিতরণ চলছে। এমনকী, দান-খয়রাতিতে টান পড়লে সাধারণের করের টাকা জমা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে! তাঁদের বক্তব্য, এমন শো করে যে করের টাকাই ওড়ানো হবে, তা আর নতুন কী?

এমএসএমই দফতরের অফিসারদের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, গত কয়েক বছর ধরে রিয়েলিটি শো শুধু জনপ্রিয়তাই পায়নি, নাচগানের জগতে বহু অজানা কৃতীরও সন্ধান দিয়েছে। পরবর্তী কালে ওই কৃতীদের অনেকেই নিজের জগতে প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। তাই এ ধরনের শোয়ের মাধ্যমে বাংলার শিল্পক্ষেত্রে কৃতী উদ্যোগীর খোঁজে নেমেছে নবান্ন। কিন্তু শুধু কৃতীর খোঁজ করে কী করবে সরকার? ওই কর্তাদের বক্তব্য, রিয়েলিটি শোয়ে প্রতিযোগীরা যেমন দর্শকের সামনে নিজের প্রতিভা তুলে ধরেন, শিল্প সংক্রান্ত শোতেও তেমনই নিজেদের সাফল্যের কাহিনি তুলে ধরবেন ছোট ও মাঝারি শিল্পদ্যোগীরা। নাচগানের প্রতিযোগিতার শেষে যেমন সেরাদের পুরস্কৃত করা হয়, এই সরকারি অনুষ্ঠানে তেমনই পুরস্কার দেওয়ার বন্দোবস্ত রাখছে এমএসএমই।

ওই অফিসারেরা বলছেন, ব্যবসার চড়াই উতরাই টপকে ছোট ও মাঝারি শিল্পদ্যোগীরা কী ভাবে জীবনে সাফল্য পেয়েছেন, তা বললে ব্যবসায় আসতে উৎসাহিত হবেন অন্যরাও। কলকাতার একটি সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে তাদের পরামর্শেই অনুষ্ঠানের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করেছে এমএসএমই। সেই রূপরেখা ধরেই মূল অনুষ্ঠানের সুর বাঁধার কাজ চলছে। ওই সংস্থাটির এক প্রতিনিধি বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে এটাই চলে আসছে, লেখাপড়ায় ভাল ছেলেমেয়েরা চাকরি করেন। যাঁরা সেই সুযোগ পান না, মূলত তাঁরাই ব্যবসা করেন। এই মানসিকতার বদল ঘটাতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ছেলেমেয়েরাও যে সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন, তা বোঝাতে হবে। ‘এগিয়ে বাংলা’ অনুষ্ঠান সেই আকাঙ্খা জাগানোরই বার্তা দেবে।’’

যদিও প্রশ্ন উঠছে, যেখানে বিনোদনই রিয়েলিটি শোয়ের মূল আকর্ষণ, সেখানে কী ভাবে শিল্পে বিনিয়োগ টানবে ওই মঞ্চ? সাধারণ ভাবে এ সব অনুষ্ঠান সমাজের সব পেশা বা সব স্তরের মানুষ দেখেন না। যেমন রান্নাঘরের অনুষ্ঠান দেখেন মূলত গৃহিণীরা, খেলা সংক্রান্ত অনুষ্ঠানের একটা বড় অংশের দর্শক পুরুষ, তেমনই ব্যবসা-বাণিজ্যের খবর দেখেন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ। তা হলে কোন যুক্তিতে শিল্প সংক্রান্ত রিয়েলিটি শো সমাজের সব স্তরের মানুষ দেখবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে প্রশাসনের অন্দরেই। যদিও এমএসএমই-র পরামর্শদাতা সংস্থার প্রতিনিধির কথায়, ‘‘সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটাই অনুষ্ঠানের সাফল্য। সেই চেষ্টাই চলছে।’’ কিন্তু কী ভাবে? খোলসা করতে চাননি ওই পরামর্শদাতা। বলেছেন, ‘‘একটু সাসপেন্স থাক না!’’

নবান্নের শীর্ষমহলের একাংশের সঙ্গে কথা বলে সেই কৌশলের আঁচ মিলেছে। এক জন বলেন, ‘‘শুধু কিছু লোক চ্যানেলে বসে তাঁদের নিজের কথা বলবেন, এটা সাধারণ মানুষ শুনবে কেন? অনুষ্ঠানের পর্বগুলো যাতে টানটান থাকে, তার জন্য অবশ্যই কিছু ‘মশলা’ ঢোকানো হবে। কী সেই মশলা? টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চনের একটি জনপ্রিয় শোয়ের প্রসঙ্গ টেনে ওই অফিসারেরা বলেন, ‘‘ওই অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ও শিল্পদ্যোগীর কথাবার্তার মধ্যে যেমন একটু হাসি-ঠাট্টা বা মশকরা থাকে, এখানেও তেমন থাকতে পারে। কিংবা কোনও শিল্পদ্যোগীর কথার সূত্র ধরে তাঁর কারখানায় কী কাজ হচ্ছে, কী ভাবে হচ্ছে, কারা করছেন, তাঁরা কী বলছেন সেই সব ছবি অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগীর পরিবারের অভিজ্ঞতা, এ সব কিছুও থাকতে পারে।’’

নবান্নের খবর, এ ধরনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা আছে এমন একাধিক সংস্থা ও বিপণন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে যাচাই-পর্বের মাপকাঠি ঠিক করেছে এমএসএমই। তাতে মূলত শিল্পদ্যোগীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। যেমন— এক জন শিল্পদ্যোগী কোথা থেকে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, কী ভাবে সফল হলেন, কেনই বা তিনি নিজেকে সফল মনে করছেন, টেলিভিশনে সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন প্রতিযোগীরা। পাশাপাশি তাঁর বাৎসরিক আয় কত, সংস্থায় কত জন কাজ করেন, বিদেশে তিনি শিল্পসামগ্রী রফতানি করেন কি না, করলে কত টাকা বিদেশি মুদ্রা আয় করেন, ব্যবসা বাড়াতে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এ সব তথ্যও দেবেন। যদিও টিভি চ্যানেলে বসে নিজের বা সংস্থার আয়-লাভ সংক্রান্ত তথ্য আদৌ শিল্পদ্যোগীরা আদৌ সবটা বলতে চাইবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে

এমএসএমই-এর এক কর্তার কথায়, ‘‘বিভিন্ন রিয়েলিটি শোয়ে যে ধরনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই কিংবা টানটান উত্তেজনা দেখি, এখানে তেমন প্রতিযোগিতা থাকবে না। আদতে প্রতিযোগিতার মোড়কে শিল্প-পরিকল্পনায় নতুনত্ব, ব্যবসার ব্যাপ্তি ও প্রকল্পের স্থায়িত্ব পর্যবেক্ষণ করবেন শিল্পপতি, ও অর্থনীতিবিদের নিয়ে তৈরি বিচারকমণ্ডলী।’’ এমএসএমই ঠিক করেছে, শোয়ের জন্য জেলাস্তর থেকে ১০০ জন শিল্পদ্যোগীকে বেছে নেওয়া হবে। এমএসএমই ছাড়া অর্থ ও পরিবেশ দফতর এবং ব্যাঙ্কের অফিসারদের নিয়ে একটা কমিটি হবে। তাঁরাই প্রাথমিক বাছাই সারবেন।

নবান্নের একাংশের কটাক্ষ, মুখ্যমন্ত্রী তো তেলেভাজাও শিল্প মনে করেন! তা হলে কি তেলেভাজার দোকানিরাও বাছাই পর্বে অংশ নিতে পারবেন? সরাসরি জবাব এড়িয়ে এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘এমএসএমই দফতরের নথিভুক্ত শিল্পের লোকজনই কেবল নাম লেখাতে পারবেন।’’

এই সংক্রান্ত আরও খবর:

বড় বিনিয়োগ কপালে নেই, ছোট চমক রিয়েলিটি শোয়ে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন