সন্তানহারা। ভাঙড়ে নিহত মফিজুলের শেষকৃত্যে কান্না বাবার। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
ভাঙড়ে গত কয়েক মাস ধরে নকশালরা যে তলে তলে জমি তৈরি করছিল, সে খবর না রাখার জন্য ঘরোয়া আলোচনায় পুলিশ-প্রশাসনকেই দুষছেন শাসক দলের নেতারা। কিন্তু তাঁরাই বা কেন হাল ধরতে পারলেন না, কেন পরিস্থিতি পুরোপুরি হাতের বাইরে চলে গেল, সেই প্রশ্নও এ বার উঠতে শুরু করেছে তৃণমূলের অন্দরে।
বস্তুত, দল ও সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই যে ভাঙড় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার পিছনে অন্যতম বড় কারণ, তা কবুল করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দু’তরফের যোগাযোগহীনতা এতটাই ছিল যে, বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় যখন ঘোষণা করছেন, স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদকে মাথায় রেখে বিদ্যুৎ সাবস্টেশন তৈরির কাজ আপাতত বন্ধ রাখা হচ্ছে, তখন জেলা তৃণমূল সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, অন্যায় প্রতিবাদ বরদাস্ত করা হবে না! ফলে প্রকল্প বন্ধের ঘোষণা কাজে আসেনি বলে মনে করছেন তৃণমূলের অনেকেই। তাঁদের মতে, পরিস্থিতি যে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে তা আঁচ করতে পারেননি দলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্ব। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, জেলা সভাপতি হিসাবে শোভনবাবুই বা দায়িত্ব এড়াবেন কী করে? দলেরই একাংশের বক্তব্য, শোভনবাবু একাধারে কলকাতার মেয়র এবং রাজ্যের আবাসন ও দমকলমন্ত্রী। তার উপরে দলের তরফে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে। এত দায়িত্ব একসঙ্গে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না তাঁর পক্ষে।
তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, দলের খাসতালুকে ক্ষোভের আগুন এবং তাকে কাজে লাগাতে নকশালদের গতিবিধির কথা জানতেন এলাকার নেতা আরাবুল ইসলাম। কিন্তু স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লাকে বিপাকে ফেলতে তিনি নীরব থেকেছেন। শীর্ষনেতাদের কিছুই জানাননি। অন্য দিকে রেজ্জাকের নিজস্ব নেটওয়ার্কও কাজ করেনি। পুলিশের মতো ব্যর্থ তিনিও। পরিস্থিতি এখন এমনই হয়েছে যে, রেজ্জাক বা আরাবুল— কেউই এলাকায় ঢুকতে পারেননি।
এমনিতেই ভাঙড় ও আশেপাশের এলাকায় রেজ্জাক, আরাবুল বা কাইজার আহমেদ, নান্নু হোসেনের মতো শাসক দলের নেতাদের পরস্পর-বিরোধী নানা স্বার্থ আছে। তাঁদের মধ্যে বনিবনা তাই কোনও দিনই নেই। জেলার নেতৃত্ব শক্ত হাতে এঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে না।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ লিখিয়ে নিয়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জমি নামমাত্র টাকায় প্রায় দখল করে নিয়েছিল আরাবুল বাহিনী। তার পরে সেই জমি বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে পাওয়ার গ্রিডের জন্য। তখন দল মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। আবার দলে যখন আরাবুলকে কোণঠাসা করা হচ্ছে এবং সেই সুযোগে তৃণমূলে নবাগত রেজ্জাক নিজের প্রভাব বিস্তার করছেন, পুরনো নেতা-কর্মীদের গুরুত্ব না দিয়ে সিপিএম ছে়ড়ে আসা লোকজনকে সামনে রাখছেন, তখনও শোভনবাবুরা কিছু করেননি। তাই টাওয়ার বসানোর কারণে বহুতল আবাসন প্রকল্প বানচাল হওয়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পের কর্তারা যখন আরাবুলের শরণাপন্ন হন, তখন তিনি রেজ্জাককে বিপাকে ফেলতে গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে ধুনো দিতে থাকেন। আর সেই ছিদ্রপথেই ঢুকে পড়ে নকশালরা।
দলে শোভন-ঘনিষ্ঠ এক নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘উনি কোনও কাজই দলনেত্রীকে না জানিয়ে করেন না। নেত্রীও আস্থা রাখেন তাঁর উপরে। তাই ভাঙড়ে এই ঘটনার পরেও সংবাদমাধ্যমের সামনে ব্যাখ্যা দিতে তিনি শোভনকেই এগিয়ে দিয়েছেন। শুধু ওঁর ব্যর্থতায় এমন ঘটনা ঘটেছে, এটা বললে সরলীকরণ হয়।’’ দলেরই বড় অংশ অবশ্য মনে করছে, ভাঙড়ের পরিস্থিতি শোভনের একার পক্ষে আর স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। হস্তক্ষেপ করতে হবে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। শিল্প সম্মেলন এবং উত্তরবঙ্গ সফর সেরে ফিরে মমতা উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূল নেতৃত্বকে নিয়ে বসতে পারেন।
তৃণমূলের আরও উদ্বেগের কারণ, উপদ্রুত এলাকা সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত। গত কয়েকটি নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট নিজের দিকে টেনেই বাজিমাত করেছেন মমতা। এখন বিজেপি-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়ে সংখ্যালঘু সমর্থন তাঁর কাছে আরও বেশি মূল্যবান। তাই নিহতদের পরিবার পিছু দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ভাঙড়-২ ব্লক অফিসে গিয়ে গুলিতে নিহত এক যুবকের দাদার হাতে বৃহস্পতিবারই সরকারি ক্ষতিপূরণের দু’লক্ষ টাকার চেক তুলে দিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পি বি সালিম।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, চেক দেওয়ার সময়ে সঙ্গে ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়। তাঁর পাশে আবার দেখা গিয়েছে তৃণমূলের বিবদমান গোষ্ঠীর নেতা আরাবুল, নান্নু, কাইজারদের। দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা, তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ আছে, এই বার্তা দিতে দলনেত্রীর পরামর্শেই মুকুলবাবু স্থানীয় সব নেতাকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। মুকুলবাবুর দাবি, ‘‘এলাকায় কিছু বহিরাগত ঢুকে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে পরিবেশ অশান্ত করেছে। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই পাওয়ার গ্রিডের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।’’