পাদুকা-পুরাণ। (বাঁ দিকে) ওয়েলিংটন জুটমিল পরিদর্শনের সময় হঠাৎই চটিতে অস্বস্তি বোধ করছেন রাহুল। (মাঝে) এক নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে দিলেন অন্য চটি। (ডান দিকে) নেতাজি ইন্ডোরের সভায় কিন্তু চটি বদলে গিয়েছে জুতোয়। শনিবার তাপস ঘোষ, পিটিআই ও সুমন বল্লভের ছবি।
বাংলা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্খাতের ডাক দিলেন রাহুল গাঁধী। নরেন্দ্র মোদী এবং তৃণমূল নেত্রীর মধ্যে নতুন সখ্যের কথা বলে বিঁধলেন বারবার। শনিবার তাঁর ঝটিকা সফরে এই আক্রমণ যদি কংগ্রেস কর্মীদের চাঙ্গা করতে বিন্দুমাত্র সাহায্য করে, তা হলে বিপরীতে প্রশ্ন উঠেছে, সারদা কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গে একটা শব্দও কেন উচ্চারণ করলেন না কংগ্রেসের সহ-সভাপতি? সে কি তৃণমূল নেত্রীকে বার্তা দিতেই?
রাহুলের দলের নেতা আব্দুল মান্নানের মামলার পরিপ্রেক্ষিতেই সারদা মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই তদন্তের জেরে এই মুহূর্তে জেলে রয়েছেন রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মদন মিত্র। এই তদন্তে সাক্ষ্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে মুকুল রায়ের। রাহুল এ দিন মান্নানের জেলা হুগলিতেও গেলেন। কথা বললেন চটকল শ্রমিকদের সঙ্গে। কিন্তু গোটা সফরে মমতাকে বহু ভাবে বিঁধলেও রাহুলের মুখে সে ভাবে শোনা গেল না সারদা প্রসঙ্গ।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন রাজ্যে এসেছিলেন, তখনও তাঁর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছিল। তিনি কংগ্রেস আমলের যাবতীয় কেলেঙ্কারির কথা বললেও সারদা প্রসঙ্গ তোলেননি। মোদীর এই বক্তৃতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব বলেছিলেন, তিনি ইউপিএ-র কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বলছিলেন। সেখানে রাজ্যের প্রসঙ্গ উঠবে কেন? এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও একই ভাবে রাহুলের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘‘ওঁর (রাহুলের) বক্তব্যে জাতীয় রাজনীতিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই সারদার বিষয় উনি তোলেননি।’’
এ সব দেখেশুনে রাজ্যের রাজনীতিকদের একাংশ বলছেন, রাহুল দুষছেন মোদীকে আর মোদী রাহুলদের। পশ্চিমবঙ্গ কি জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তরজার জায়গা? এ রাজ্যের মূল রাজনৈতিক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেস। অথচ দুই নেতার কেউই তৃণমূলকে বিঁধতে সারদার মতো ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগ করলেন না! এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি রাহুল এই ভাবে মমতাকে বার্তা দিয়ে ভবিষ্যতে তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতার দরজা খুলে রাখলেন?
অধীর চৌধুরীরা অবশ্য এ কথা মানতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্য, তা-ই যদি হবে, তা হলে রাহুল তাঁর গোটা বক্তৃতায় কড়া ভাষায় মমতাকে বিঁধলেন কেন?
বস্তুত, রাহুলের এ দিনের মূল লক্ষ্য ছিল মোদী-মমতা সখ্য। এর আগে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন মনমোহন সিংহও ঢাকা সফর করেছিলেন। কিন্তু মমতা তাঁর সঙ্গে যাননি। অথচ মোদীর সঙ্গে তিনি শুধু ঢাকা সফর করলেনই না, সেখানে স্থলসীমান্ত চুক্তির সময় সশরীর হাজির রইলেন। শনিবার নেতাজি ইন্ডোরে দলের কর্মিসভায় রাহুল গাঁধী এই প্রসঙ্গ তুলে আক্রমণ করেন মমতাকে। বলেন, ‘‘যখন ইউপিএ সরকার ছিল, আমরা বলেছিলাম তাঁকে আমাদের সঙ্গে যেতে। কিন্তু তিনি যাননি। ‘একলা চলো’র ধুয়ো তুলেছিলেন। এখন মোদী এসেছেন, তাই আর ‘একলা চলো’ নয়!’’ তার পরেই তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কেন এমন হল? কীসের এতো সখ্য দু’জনের?’’
শুধু মোদী-মমতার বন্ধুত্বই নয়, তাঁর কুড়ি মিনিটের বক্তৃতায় তৃণমূল নেত্রীকে আরও অন্য ভাবেও আক্রমণ করেছেন রাহুল গাঁধী। যেমন, রাজ্যের উন্নয়ন। প্রশ্ন তুললেন, ‘‘এ রাজ্যে এক কোটি যুবক বেকার। বাংলায় শিল্প কোথায়?’’ এর সঙ্গে জুড়ে দিলেন তৃণমূল সরকারকে অপসারণের ডাক। বললেন, ‘‘রাজ্যের বিকাশের গাড়ির ব্রেকে পা দিয়ে বসে রয়েছে মমতা সরকার। কংগ্রেসকে ওই গাড়িতে বসালে অনেক জোরে গাড়ি চলবে।’’
স্বাভাবিক ভাবেই রাহুলের কথায় উজ্জীবিত কংগ্রেস। অনেকেই বললেন, সারদা প্রসঙ্গ না থাকলেও কংগ্রেসকে রাজ্যে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে তুলে ধরার কথা বলে রাহুল ‘একলা চলো’রই ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। অন্য একটি অংশের অবশ্য দাবি, রাহুল আসলে মমতার সঙ্গে সমঝোতার বার্তাই দিয়ে গেলেন।
কংগ্রেস কর্মীরা এই কথার সঙ্গে একমত হবেন কি না, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন রইলই। কর্মিসভাতেই রাহুলের সামনে প্ল্যাকার্ড তুলে কেউ কেউ ‘তৃণমূলের সঙ্গে জোট করবেন না’। রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ দীপা দাশমুন্সি তো সাফ বললেন, ‘‘কংগ্রেসের আব্দুল মান্নানই সুপ্রিম কোর্টে সারদা নিয়ে মামলা করেছিলেন। সারদার রং এখন অনেকটাই ফিকে। সিবিআই তদন্তও ঢিলেঢালা। ওই জায়গাটায় আমাদের আঘাত করে আন্দোলন চালাতে হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের আন্দোলনের গতি বাড়াতে হবে।’’
রাহুলও বোঝেন, মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং ‘উন্নয়নের গাড়ি’র বেগ বাড়াতে কংগ্রসেকে অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। এবং একই সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বকে অত্যাচারিত কর্মীদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। বস্তুত, প্রদেশ নেতৃত্বকে বার্তা দিতেই যেন তিনি বললেন, ‘‘বামেদের প্রতীক কাস্তে-হাতুড়ি। আগে এখানে এসে দেখেছি, হাতুড়ির বাড়ি পড়ত। এখন দেখছি, তৃণমূলের ফুল হাতুড়ির থেকেও বেশি জোরে মারছে!’’ অত্যাচারিত কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাহুল এমনকী এ-ও বলেন, ‘‘মমতার দলের দু’তিনটে লাঠির ঘা আমিও খেতে চাই।’’
শুধু কর্মিসভা বা চটকল শ্রমিকদের সঙ্গে সাক্ষাতই নয়, রাহুল এ দিন কথা বলেন শহরে বাড়ি-ফ্ল্যাট বা বাংলো কিনে প্রতারিত হয়েছেন, এমন উপভোক্তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও। পোর্ট ট্রাস্টের অতিথিশালায় এই প্রতিনিধিরা এসে দেখা করেন তাঁর সঙ্গে। পরে এঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাহুল প্রদেশ নেতৃত্বকে বলেন।
রাহুলের এই আক্রমণ বা সফরকে অবশ্য বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব। সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘২০১৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল। একটা পয়সা দিয়েও বাংলার সরকারকে তারা সাহায্য করেনি।’’ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরই কটাক্ষ, ‘‘কে বলছেন এ সব? রাহুল গাঁধী! যাঁর নেতৃত্বে লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে!’’
আর ঢাকায় একসঙ্গে মোদী-মমতার সফর নিয়ে মুখ খুলেছেন বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। তাঁর কথায়, ‘‘মনমোহন রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে ঢাকা গিয়েছিলেন। কিন্তু মোদীজি বোঝেন, ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তৃণমূল-বিজেপির রাজনৈতিক লড়াইকে দূরে রেখেই তিনি রাজ্য সরকারকে সঙ্গে নিয়েছেন।’’