খাবারের দায়িত্ব ছেড়ে নালিশ-কাঁটা এড়াতে মরিয়া রেল

ট্রেনে খাবার আর খাবারের মান নিয়ে টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। তার মধ্যেই বেশি যাত্রীকে সফরের সুযোগ দেওয়ার জন্য রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো নামী ট্রেনেও প্যান্ট্রিকারের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এ বার এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপে যাত্রীদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বই কার্যত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে রেল।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৬ ০৩:৪৬
Share:

ট্রেনে খাবার আর খাবারের মান নিয়ে টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। তার মধ্যেই বেশি যাত্রীকে সফরের সুযোগ দেওয়ার জন্য রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো নামী ট্রেনেও প্যান্ট্রিকারের সংখ্যা কমানো হয়েছে। এ বার এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপে যাত্রীদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বই কার্যত ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে রেল।

Advertisement

প্রাথমিক ভাবে দু’টি রাজধানী ও দু’টি শতাব্দী এক্সপ্রেসে পরীক্ষামূলক ভাবে এই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। রেল মন্ত্রকের কর্তারা জানান, এই ব্যবস্থা সফল হলে ধাপে ধাপে অন্য ট্রেনেও খাবারের দায়িত্ব ছেড়ে দেবে রেল।

এখন রাজধানী, শতাব্দী ও দুরন্ত এক্সপ্রেসে টিকিটের সঙ্গেই খাবারের দাম নেওয়া হয়। নতুন ব্যবস্থায় টিকিটের সঙ্গে খাবারের দাম দিতে হবে না। ফলে টিকিটের দাম কমবে বলে জানান রেলকর্তারা। নয়াদিল্লি-রাজেন্দ্রনগর-পটনা রাজধানী ও নয়াদিল্লি-মুম্বই সেন্ট্রাল অগস্ত্যক্রান্তি রাজধানী এবং নয়াদিল্লি-পুণে শতাব্দী ও হাওড়া-পুরী শতাব্দী এক্সপ্রেসে ১৫ জুন থেকে নতুন এই ব্যবস্থা চালু করার কথা জানিয়েছে রেল বোর্ড।

Advertisement

এতে এক ব্যবস্থায় দু’টি পাখি মারার চেষ্টা দেখছেন রেলেরই কর্মী-অফিসারদের একাংশ। l খাবারের দায়িত্ব হাতে না-রাখলে তা নিয়ে অভিযোগের দায়ও নিতে হবে না। l বাজারদর যে-ভাবে বাড়ছে, তাতে খাবারের দাম না-বাড়ালেই নয়। কিন্তু খাবারের দাম বাড়ালে টিকিটেরও দাম বাড়বে। কর্তারা সেটাও চান না।

রেল হাত গুটিয়ে নিলে চলন্ত ট্রেনে খাবার মিলবে কী ভাবে?

রেলকর্তাদের আশ্বাস, রাজধানী, দুরন্ত বা শতাব্দীতে খাবার থাকবেই। চাইলেই তা পাওয়া যাবে। তার জন্য টিকিট কাটার সময় জানাতে হবে। পরেও ই-কেটারিং বা অ্যাপসেও বিভিন্ন সংস্থার খাবারের অর্ডার দেওয়া যাবে। তা সরবরাহ করবে রেলের সহযোগী সংস্থা ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কেটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন বা আইআরসিটিসি।

তা হলে নতুন ব্যবস্থা কী হল?

রেলকর্তাদের একাংশের যুক্তি, টিকিট কাটার সময় টাকা নেওয়ায় নিয়মিত যথাযথ মানের খাবার সরবরাহের পুরো দায়টাই তাঁদের ঘাড়ে চাপত। যাত্রীদের অভিযোগ, অন্য কোনও উপায় না-থাকায় বাধ্য হয়েই রেলের দেওয়া খারাপ মানের খাবার খেতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে নিয়ম বদল করে বলটা যাত্রীদের কোর্টেই ঠেলে দিল রেল। অর্থাৎ অভিযোগের দায়টা আর নিজেদের ঘাড়ে রাখতে চায় না রেল।

স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন স্টেশনে রেলের কেটারিং ছিল। আগেভাগে বরাত দিলে নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে খাবার তুলে যাত্রীদের দেওয়া হতো। পরে চলন্ত ট্রেনেই খাবারের ব্যবস্থা করে রেল। বহু ট্রেনে রেলের কামরার মধ্যেই ‘বুফে কার’ বা খাবারের কামরা থাকত। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তমকুমার ও শর্মিলার আলাপচারিতার দৃশ্যে তা দেখা গিয়েছিল। ‘‘অনেকটা রেস্তোরাঁর মতোই ছিল সেটা,’’ স্মৃতি উস্কে বলছেন এক প্রাক্তন রেলকর্তা। রাজধানী, শতাব্দীর মতো সুপারফাস্ট ট্রেন চালু হওয়ার পরে বুফে কার তুলে দিয়ে প্যান্ট্রিকার চালু করা হয়। সেই ব্যবস্থায় আসনে বসেই প্যাকেটবন্দি খাবার পেতেন যাত্রীরা।

রেলের পরিচালন ব্যবস্থার দিক থেকেও বদল এসেছে কেটারিংয়ে। এক সময় কেটারিং বিভাগের পুরো দায়িত্ব রেলের হাতে থাকলেও পরে সহযোগী সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আইআরসিটিসি। যাত্রীদের খাবার সরবরাহের বেশির ভাগ দায়িত্ব সহযোগী সংস্থাকেই দিয়ে দেয় রেল।

গোলমালটা বাধল কোথায়?

২০১০ সাল নাগাদ রেল ফের ওই দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আর বিপত্তির শুরু তখন থেকেই। এক বার কেটারিং সার্ভিস তুলে দিয়ে রেল ফের নিজেদের হাতে সেই দায়িত্ব নেওয়ায় গোটা ব্যবস্থাটাই কার্যত ভেঙে পড়ে। রেলের নিজস্ব কেটারিং বিভাগ ক্রমশ ঢিলেঢালা হয়ে পড়ায় খাবার নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠতে থাকে। কী রকম অভিযোগ?

যাত্রীদের অভিযোগ, রেলকর্তাদের ঠিক করে দেওয়া মেনু বা খাদ্যতালিকা রীতিমতো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। সর্বোপরি খাবারের মান নিয়েও প্রায় রোজই রেলের খাতায় জমা হচ্ছিল হাজরো অভিযোগ। নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার সরবরাহ এবং খাবারে আরশোলার উপস্থিতি নিয়েও যাত্রীরা সরব হয়েছেন বারবার।

সেই সব অভিযোগের প্রতিকার না-করে রেল নতুন যে-ব্যবস্থা চালু করতে চলেছে, তার কথা শুনে এখন থেকে অনেকেই নাক কোঁচকাচ্ছেন। এই বন্দোবস্তে অন্য রকম অসুবিধের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রাজধানী এক্সপ্রেসে মাসে এক বার দিল্লি যাতায়াত করা এক সরকারি কর্তা বলছেন, ‘‘ট্রেনে কী খাব, তা নিয়ে অন্তত চিন্তা করতে হতো না। সময়মতো খাবারটা অন্তত মিলত। নতুন ব্যবস্থা চালু হলে অনেকেই তো বিভ্রান্ত হবেন!’’ আবার এতে কিছুটা সুরাহার আশাও করছেন কেউ কেউ। যেমন এক বৃদ্ধ যাত্রী বললেন, ‘‘রেল তো নিজেরা যেটা ভাল মনে করত, সেই খাবারই তৈরি করত। খাবার বাছাইয়ের কোনও স্বাধীনতাই ছিল না যাত্রীদের। এ বার থেকে ইচ্ছেমতো মেনু ঠিক করতে পারব।’’

অনেক সময়েই দেখা যেত, রেলের গতে বাঁধা মেনু পছন্দ না-হওয়ায় বহু অবাঙালি যাত্রী খোঁজ নিতেন, নিরামিষ মারোয়াড়ি বা গুজরাতি খানা আছে কি না। অনেকে নিতান্ত দায়ে পড়েই বাঙালি বা কন্টিনেন্টাল খাবারে পিত্তরক্ষা করতেন। ‘‘এ বার থেকে ই-কেটারিং বা অ্যাপসে অর্ডার দিলে ইচ্ছেমতো খাবার মিলবে,’’ আশ্বাস এক আইআরসিটিসি-কর্তার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন