বিজ্ঞানের ক্লাস তো স্কুলে হয়ই। কিন্তু এ যেন বিজ্ঞানের পাঠশালা!
সেখানে ভারিক্কি নামের কচকচি নেই। জটিলকুটিল হিসেব নেই। বরং আমাদের চার পাশে যা নিত্য ঘটে চলেছে, তারই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বৃদ্ধ পরিবেশবিদ কিংবা জাতীয় স্তরে পরিচিত বিজ্ঞানকর্মীরা। এবং এই গোটা প্রক্রিয়ার পিছনে রয়েছেন এমন কয়েক জন, যাঁদের জীবন চলে ঘড়ি ধরে, ট্রেনের টাইম টেবিল মেনে।
নিজেদের আয় থেকে টাকা বাঁচিয়ে ‘বান্ধব শিয়ালদহ’ নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খুলেছেন শিয়ালদহের এক দল রেলকর্মী। বিজ্ঞানচর্চাকে রাজ্যের স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দিতে তাঁরাই শুরু করেছেন বিজ্ঞানের ‘পাঠশালা’। সেই পাঠশালায় পণ্ডিতমশাইয়ের দায়িত্ব পালন করছেন রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত বনকর্তা ও পরিবেশবিদ প্রণবেশ সান্যাল, বিজ্ঞান প্রচারক মানসপ্রতিম দাসের মতো মানুষজন।
সম্প্রতি এমনই পাঠশালা বসেছিল উস্তির একটি স্কুলে। আমাদের চার পাশে থাকা প্রাণিকুল এবং তাদের ভূমিকা চেনাতে গিয়ে প্রণবেশবাবু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘পুকুরে তারখেল থাকলে কী উপকার হয়?’’ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দেওয়ার জন্য হাত উঠতে শুরু করেছিল। তা দেখিয়ে পাশে বসে থাকা সংগঠনের এক সদস্য বলছিলেন, ‘‘গোসাপ বা ওয়াটার মনিটর লিজার্ডের থেকে তারখেল শব্দটাই ওরা বেশি চেনে। তাই ভারী শব্দ এড়িয়ে এমন শব্দই ব্যবহার করেন স্যার।’’ ঠিক এ ভাবেই শহরের স্কুলে উঠে এসেছিল লাল গ্রহের রহস্যের কথা। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, ইন্টারনেটের যুগে শহুরে পডুয়াদের কাছে মঙ্গল গ্রহ অপরিচিত নয়। কিন্তু তার রহস্যভেদের কথা শুনতে শুনতে অনেকেরই চোখে আলো ফুটে উঠতে দেখা গেল।
কিন্তু হঠাৎ এমন উদ্যোগ কেন?
সংগঠনের সদস্য রাজীব রায়, অধীপ আইচেরা জানাচ্ছেন, বিজ্ঞানে দেশ এগিয়েছে। কিন্তু খুদে পড়ুয়াদের মধ্যে এখনও পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ নয়। অজ্ঞানতা থেকেই নানা কুসংস্কারে জড়িয়ে পড়ে তারা। ফলে বিজ্ঞানের পড়া পুথিগত বিদ্যাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তার কোনও প্রভাব পড়ে না রোজকার জীবনযাত্রায়। বিজ্ঞানচর্চায় তাদের সামিল করতে পারলে এই ধরনের সমস্যা কাটিয়ে তোলা যাবে। তাই সহজ ভাষাকে হাতিয়ার করেই আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার অভাব কতটা, নিজের চোখে দেখা সেই দৃষ্টান্তের কথা বললেন সংগঠনের কিছু কর্মী। তাঁদের এক জন বলেন, ‘‘সোনারপুর স্টেশনের কাছে দু’টি দাঁড়াশ সাপ ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ দেখলাম, কয়েকটি কিশোর এসে লাঠিপেটা করে ওদের মেরে ফেলল! অথচ দাঁড়াশ সাপ বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এটা ওদের কেউ কোনও দিন বলেন।’’
একই ভাবে বারাসতের ময়নার কাছে ডাহুক শিকারের জন্য পাতা সুতোর ফাঁদ দেখেছিলেন রাজীববাবু। সেই ফাঁদে পাখিগুলি তো মরছিলই, শিকার করতে এসে রেহাই পায়নি একটি মেছো বেড়ালও। সংগঠনের সদস্যদের আশা, তাঁদের অভিযান নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা বাড়াবে। ফলে বাঁচবে এই পৃথিবীর গাছপালা, অবোলা প্রাণীগুলিও।