রাজীব ও রেশমি
একেবারে শেষ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের খেলাটা দেখেছিল ক্রিকেট-পাগল রাজীব। চ্যাম্পিয়নস্ ট্রফির সেমিফাইনাল বলে কথা— একা একা খেলা দেখার মজা কই! তাই পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে পড়শির বাড়িতে বসে খেলা দেখে রাত করে বাড়ি ফিরেছিল। সেই ছেলেটার মৃতদেহই পোড়া ঘর বের হবে সকালে, ভাবতে পারেননি কেউ।
পাড়া থেকে স্কুল, সর্বত্রই ভাল ছেলে হিসাবেই পরিচিত ছিল বছর পনেরোর কাজি রাজীব। বিকেল হলেই ব্যাট নিয়ে সোজা মাঠে, আর চোখে স্বপ্ন— ‘মাটির বাড়িটা বড় হয়ে পাকা করব আমি’। বন্ধুর কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসছিল আবদুল হোসেনের। আবদুল বলে, ‘‘আমরা তো রোজ একই বেঞ্চে বসতাম। রাজীব বলত ওর বাবা খুব কষ্ট করে ওদের বড় করছে। ও বড় হয়ে সুরাহা একটা করবেই।’’
পারিবারিক বিবাদের জেরে রাজীবের কাকা কাজি ইসমাইল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে রাজীব আর তার দিদি বছর সতেরোর রেশমি খাতুনের। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কলকাতার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তাদের মা ফতেমা বিবি।
ঘাটাল থানার সুন্দরপুর গ্রামে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকতেন ফতেমা বিবি। স্বামী কাজি হাসেম আলি বড় ছেলে ফরিদকে নিয়ে মুম্বইয়ে কাঠের মিস্ত্রির কাজ করেন। ছোট ছেলে রাজীব পড়াশোনায় ভালই ছিল। স্থানীয় জয়নগর হাইস্কুলের দশম শ্রেণিতে পড়ত সে। দিদি রেশমিও আগে সে স্কুলেই প়়ড়ত। সম্প্রতি সে ভর্তি হয়েছিল বলরামপুর হাইমাদ্রাসায়। দুই ভাইবোন কখনও সাইকেলে, কখনও হেঁটে স্কুলে যেত একসঙ্গে। তাদের কেউ কখনও ঝগড়া করতে দেখেননি। তাদেরই এক আত্মীয় শেখ আখতারউল বললেন, “ওদের দু’জনের খুব মিষ্টি স্বভাব ছিল। ইদের দিন আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল রেশমির। প্রতিদিন ফোন করত ও। ছোট্ট জীবন দু’টো এ ভাবে শেষ করে দিল!’’
রেশমির স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাইফুল হোসেন মল্লিক বললেন, “মেয়েটা এ বছরই আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে আগে থেকেই চিনি। ওর বাবাও খুব ভাল মানুষ। ছেলেমেয়ে দু’টো এ ভাবে শেষ হয়ে গেল ভাবতেই পারছি না।’’ খবর পৌঁছতেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল রাজীবের স্কুলে। সহকারী শিক্ষক কিংশুক দত্ত বললেন, “রাজীব পড়াশোনায় খারাপ ছিল না। তবে খেলার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। শান্ত ছেলেটা স্কুলে কোনও দিন কারও সঙ্গে গণ্ডগোল করেনি।”
দুই ছেলেমেয়ের মৃত্যুতে ক্ষোভে ফুঁসছেন পাড়ার সকলে। প্রতিবেশী, পাড়ার দোকানদার সকলেই হতভম্ভ। স্থানীয় কাজীরহাট বাজারের ব্যবসায়ী মইনুদ্দিন খান বলেন, “স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মাঠে চলে আসত রাজীব। দোকানে খদ্দের না থাকলে আমাকেও ডেকে নিয়ে যেত। বলত, কাকু চলে এসে বল করবে। প্রায়ই ওর সঙ্গে খেলতাম। সেই ছেলের এমন হবে কে জানত।”
পোড়া ঘরে আর কোনও দিন ফিরবে না রাজীব, রেশমি। তবে শুক্রবার ময়নাতদন্তের পর তাদের মৃতদেহ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুন্দরপুর গ্রামের বাড়িতেই। আজ, শনিবার দেশের বাড়িতে ফিরবেন বাবা, দাদা। তারপর শেষকৃত্য হবে ছেলেমেয়ের।
এ দিন সারাদুপুর দাওয়ায় বসে একটানা কেঁদেছেন সমনিমা বিবি। তাঁর বা়ড়িতেই আগের রাতে খেলা দেখে এসেছিল রাজীব। টানাটানা চোখের রেশমী, মায়ের হাতে হাতে কাজ করে দিত আর মিষ্টি হাসত— কিছুই ভুলতে পারছেন না তিনি।