Nusrat Jahan Rakesh Singh

নুসরত বলছেন, তিনি ঋণ নিয়েছিলেন অভিযুক্ত সংস্থা থেকে, সেই সংস্থার ডিরেক্টর শুনে স্তম্ভিত!

২০১৪ সালের শেষে নুসরত ওই সংস্থার ডিরেক্টর হিসাবে যুক্ত হন। ২০১৭-র শুরুতে সংস্থা থেকে ইস্তফা দেন। সংস্থার ডিরেক্টরের দাবি, নুসরত সংস্থায় যুক্ত হওয়ার আগেই পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি হয়।

Advertisement

সারমিন বেগম

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ২১:০২
Share:

(বাঁ দিকে) রাকেশ সিংহ। নুসরত জাহান (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

‘বিতর্কিত’ সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার দাবি করেছিলেন সাংসদ নুসরত জাহান। সেই সংস্থার ডিরেক্টর পাল্টা দাবি করলেন, তাঁরা ওই সংস্থা থেকে নুসরতকে কোনও ঋণ দেননি। বস্তুত, বুধবার নুসরতের ওই দাবির পরে বৃহস্পতিবার ওই সংস্থার ডিরেক্টর রাকেশ সিংহ আনন্দবাজার অনলাইনকে জানান, তিনি নুসরতের দাবির কথা শুনে ‘শক্‌ড’ (স্তম্ভিত)!

Advertisement

দু’জনের কথা থেকে স্পষ্ট যে, কেউ একজন সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। তিনি কে, সেটা নিয়েই আপাতত ধন্দ দেখা দিয়েছে। যার ফলে গোটা বিষয়টি আরও গোলমেলে এবং ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। রাকেশের বক্তব্য সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ার জন্য নুসরতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কোনও জবাব দেননি। নুসরত জবাব দিলে তাঁর বক্তব্য এই প্রতিবেদনে যথাবিহিত উল্লেখ করা হবে।

গত সোমবার থেকে নুসরতকে নিয়ে ওই বিতর্কের সূত্রপাত। বিজেপির নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা অভিযোগ করেছিলেন, ২০১৪-’১৫ সালে ৪০০-র বেশি প্রবীণ নাগরিক ‘সেভেন সেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ নামে একটি সংস্থায় অর্থ জমা দেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছিল। বদলে তাঁদের এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সাল নাগাদ তাঁদের জানানো হয়, ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করা যাচ্ছে না। তাঁদের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। অভিযোগকারীদের বক্তব্য, তাঁদের অনেকেই পুরো টাকা ফেরত পাননি। অনেকে কোনও টাকাই পাননি। অনেকে অল্প কিছু টাকা করে পেয়েছেন।

Advertisement

বিষয়টি নিয়ে তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হন। যান ক্রেতাসুরক্ষা দফতরের কাছেও। আদালত কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনারকে (অপরাধ) তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে সেই তদন্ত রিপোর্টে ‘অনিয়ম’ পাওয়া গিয়েছে বলে খবর। গত জানুয়ারি মাসে নুসরতকে আদালতে হাজিরা দিতেও বলা হয়েছিল। কিন্তু নুসরত আদালতে যাননি। প্রসঙ্গত, বুধবার নুসরতও বলেছিলেন, ওই বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন।

অভিযোগকারীরা প্রথমে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কাছে গিয়েছিলেন। শুভেন্দু মঙ্গলবারেই সে কথা জানিয়ে বলেছিলেন, তিনিই শঙ্কুকে বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে ইডির দ্বারস্থ হতে। সেই মতো শঙ্কু ওই প্রবীণদের মধ্যে কয়েকজনকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে নিয়ে যান। তার পরেই বিষয়টি আবার প্রকাশ্যে এসে পড়ে। শঙ্কু যেমন নুসরতের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা এবং গ্রেফতারি দাবি করেন, তেমনই শুভেন্দু বলেন, নুসরতের ফ্ল্যাটটি ‘দুর্নীতি’র টাকায় কেনা! নুসরত অবশ্য সেই অভিযোগ বুধবার উড়িয়ে দেন।

ঘটনাচক্রে, বুধবারেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। এটা ওদের (নুসরতের) বিষয়। সেটা ওরা (নুসরত) নিজেরাই বলবে।’’ তবে একইসঙ্গে মমতা অভিযোগ করেছিলেন, প্রামাণের আগেই দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বিচারসভা (মিডিয়া ট্রায়াল) বসিয়ে দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেছিলেন, ‘‘ডিরেক্টর তো অনেকেই থাকে! নুসরত যদি কোনও জায়গায় ডিরেক্টর থেকেও থাকে, তা হলে ওরকম ডিরেক্টর তো অনেক আছে! ওদেরও (বিজেপির) তো কে একজন সাংসদ আছেন, যাঁর বিরুদ্ধে ইডিতে কমপ্লেন (অভিযোগ) আছে। যিনি বিদেশেও গিয়েছিলেন চিটফান্ডের মালিকের সঙ্গে। আমি নাম বলতে চাইছি না।’’

বুধবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে নুসরত নিজের বক্তব্যই জানান। সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি। মেরেকেটে ১০ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠকে নুসরত বলেছিলেন, ‘‘যে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাদের থেকেই ১ কোটি ১৬ লক্ষ ৩০ হাজার ২৮৫ টাকার ঋণ নিয়েছিলাম। সেই টাকায় বাড়ি কিনেছি। ২০১৭ সালের ৬ মে সুদ-সহ ১ কোটি ৪০ লক্ষ ৭১ হাজার ৯৯৫ টাকা ফেরত দিয়েছি কোম্পানিকে। ব্যাঙ্কের নথিও আমার কাছে আছে। ৩০০ শতাংশ চ্যালেঞ্জ করতে পারি যে আমি দুর্নীতিতে যুক্ত নই! আমি এক পয়সা নিলেও এখানে আসতাম না।’’ নুসরতের আরও বক্তব্য, তিনি ওই সংস্থার শেয়ারহোল্ডারও নন। তিনি ওই সংস্থার ডিরেক্টরের পদ থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ইস্তফা দিয়েছেন। তার পরে তাঁর সঙ্গে ওই সংস্থার আরও কোনও সম্পর্ক নেই।

নুসরতের ওই দাবি সম্পর্কে বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে রাকেশ বলেন, ‘‘আমি তো ওঁর ওই কথা শুনে শক্ড! আমরা কোথায় ঋণ দিলাম? আমরা তো প্রপার্টিতে পেমেন্ট করেছি। উনি তো অন্য একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।’’ প্রপার্টিতে পেমেন্ট মানে কী? সেটিও বুঝিয়ে বলেছেন রাকেশ। তিনিই জানিয়েছেন, ‘অভিযুক্ত’ সংস্থার সঙ্গে নুসরতের কবে যোগ, কবে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ হয়েছিল।

রাকেশের দাবি, ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর নুসরত ওই সংস্থায় ‘ডিরেক্টর’ হিসাবে যুক্ত হন। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ইস্তফা দেন ওই পদে। রাকেশের এ-ও দাবি, নুসরত তাঁদের সংস্থায় যুক্ত হওয়ার আগেই পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটটি কেনার বিষয়ে একটি নির্মাণ সংস্থার সঙ্গে তাঁদের সংস্থার চুক্তি হয়েছিল। তার পরে নুসরত তাঁদের সংস্থায় যুক্ত হলেন ডিরেক্টর হিসাবে। কিছু দিনের মধ্যেই পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটটি পছন্দ হয়ে যায় তাঁর।

রাকেশের দাবি, নুসরতের সঙ্গে তাঁদের ২০১০-’১১ সাল থেকে চেনাজানা। তাঁর আরও দাবি, পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটটি যখন নুসরতকে হস্তান্তর করা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই সাংসদ-অভিনেত্রী ওই সংস্থা থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন। রাকেশের বক্তব্য, তিনিই নুসরতকে বলেছিলেন ডিরেক্টর থেকে এ ভাবে সংস্থার সম্পত্তি নেওয়া যায় না। সেটা বেআইনি। তার পরেই নুসরত ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

তবে রাকেশ এ-ও জানিয়েছেন, নুসরত সংস্থার ডিরেক্টর থাকাকালীন কোনও বেতন নিতেন না। রাকেশের বক্তব্য, নিউটাউনে প্রবীণ নাগরিকদের ফ্ল্যাট দেওয়ার যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, তার ‘মুখ’ হিসাবে নুসরতকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা ছিল ওই সংস্থার। যা নিয়ে মূল অভিযোগ। ৪০০-র বেশি প্রবীণ নাগরিকের অভিযোগ, ফ্ল্যাট দেওয়ার নামে প্রতারণা করেছে ‘নুসরতের সংস্থা’। টাকা আত্মসাৎ করে আর ফ্ল্যাট দেয়নি।

রাকেশ জানান, পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটটির দাম ছিল ১ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা। পাশাপাশিই তাঁর দাবি, ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা দিয়ে তাঁর সংস্থার নামে ফ্ল্যাটটি কেনা হয়েছিল। বাকি ছিল ৫৮ লক্ষ টাকা। এর পর নুসরত যখন ফ্ল্যাটটি পছন্দ করেন, তখন ওই বাকি ৫৮ লক্ষ দিয়ে নিজের নামে ফ্ল্যাটটি তিনি রেজিস্ট্রি করিয়ে নেন। এর পর রাকেশের কাছে বা তাঁর সংস্থার কাছে নুসরতের যে ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা বাকি পড়ে, তা শোধ করার জন্য পৃথক একটি সংস্থা থেকে নুসরত ঋণ নেন। তার পরে ওই ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা শোধ করে দেন।

এখানেই নুসরত এবং রাকেশের বক্তব্যে গরমিল। নুসরত বলেছিলেন, ‘সেভেন সেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ নামে ওই সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাটটি কিনেছেন। কিন্তু রাকেশের বক্তব্য, ‘‘সংস্থা কেন ঋণ দেবে?’’ নুসরত একটি কিছু নথিপত্র-ভরা নীল রঙের ফাইল দেখিয়ে দাবি করেছিলেন, তাঁর কাছে সব নথি আছে। তিনি কেন ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না-নিয়ে ওই সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, তার কোনও জবাব নুসরত বুধবার দেননি। বস্তুত, তিনি কোনও প্রশ্নেরই জবাব দেননি।

নুসরতের সাংবাদিক বৈঠকের পরে বিজেপি নেতা শঙ্কু আবার পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন, কোনও একটি সংস্থা তার ডিরেক্টরদের ঋণ দিতে পারে কিনা, তা ‘আরওসি’ খতিয়ে দেখুক। বৃহস্পতিবার রাকেশও দাবি করলেন, তাঁর সংস্থা নুসরতকে ঋণ দেয়নি। ফলে বিষয়টি আরও ঘোরাল হয়ে দাঁড়াল বলেই অনেকে মনে করছেন। অনেকের মতে, এখানেই নুসরতের টাকার উৎস নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠে গেল। এখন দেখার, নুসরত এর প্রেক্ষিতে কী পদক্ষেপ করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন