একসঙ্গে উৎসব বিরোধীদের। —নিজস্ব চিত্র।
শাসক তৃণমূলকে এলাকায় কার্যত দাঁত ফোটাতে দিল না বাম, কংগ্রেস, বিজেপি জোট। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লকে মহকুমা পরিষদের দুটি আসন খড়িবাড়ির সর্বত্রই বিজয়ী প্রার্থীদের নিয়ে লাল আবিরের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতে দেখা গিয়েছে বুধবার।
ভোট গণনা তখনও শেষ হয়নি। গণনাকেন্দ্রের বাইরে নির্দল প্রার্থীকে নিয়ে বিজয় মিছিল করছে সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস, বিজেপি। তৃণমূলকে হারাতে ভোটের দিনেও সিপিএমকে সামনে রেখে সে চিত্রটা বিভিন্ন জায়গায় দেখা গিয়েছে শাসক বিরোধী শিবিরে। ভোট গণনার পর সেই জোটটাই প্রকাশ্যে হুল্লোড় করে মেতে উঠেছে খড়িবাড়িতে। একাধিক অতিকায় সাউন্ড বক্স, জকি নিয়ে গান চালিয়ে তার তালে কোমর দোলাচ্ছে সিপিএমের খড়িবাড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক রাম কুমার ছেত্রী থেকে অন্যরাও। বিজেপি’র পতাকা, কংগ্রেসের পতাকা, সিপিএম এবং তাদের শরিক দলের পতাকা মিলে মিশে একাকার বিজয় মিছিলে।
গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত হাজার দুয়েক কর্মী-সমর্থককে দেখা গিয়েছে লাল আবির উড়িয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসতে। সকাল থেকে গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। পরে ফিরে গিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় মিছিল আড্ডায় তারা মেতেছে রাত পর্যন্ত।
পঞ্চায়েত সমিতির ১২ টি আসনের মধ্যে ৫টি সিপিএম এবং ২টি ফরওয়ার্ড ব্লক নিজেদের দখলে নিয়েছে। তৃণমূল ৪টি আসনে জিতেছে। নির্ধল প্রার্থী জিতেছে একটিতে। গত বছর সেখানে তারা ৫টি আসনে জিতেছিল। তার আগের নির্বাচনে পঞ্চায়েত সমিতিও তাদের দখলে ছিল। অথচ এ বার তাদের শোচনীয় অবস্থায় পঞ্চায়েত সমিতিতেও। খড়িবাড়ি ব্লকে মহকুমা পরিষদের দুই আসনের একটিতে (৫ নম্বর আসনে) ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী তাপসি রায় মণ্ডল জিতেছেন ১৩২২ ভোটের ব্যবধানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলক হারিয়ে। ওই ব্লকে অপরটি ৬ নম্বর আসনে সিপিএম প্রার্থী পার্ভতী সিংহ জিতেছেন তৃণমূলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৩৮০ ভোটে হারিয়ে।
কংগ্রেসের জেলা সভাপতি শঙ্কর মালাকার বলেন, ‘‘তৃণমূল আমাদের দল ভাঙানো ছাড়া কিছু করেনি। তাতে তারা বামেদের সুবিধে করে দিয়েছে। মহকুমার সর্বত্রই সেটা দেখা গিয়েছে। অথচ তারা নিজেরাও কিছু করতে পারেনি। খড়িবাড়িতেও তাই ঘটেছে।’’ শঙ্করবাবু এ কথা বললেও ভোটের আগে তারাও শাসক দলকে রুখতে তৃণমূলের ভোট লুটের চেষ্টার অভিযোগ তুলে একযোগে চলার কথা জানিয়েছিলেন।
ব্লকের চারটে গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে বিন্নাবাড়ি, বুড়াগঞ্জ নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছে বামেরা। বিন্নাবাড়ি বরাবরই ফরওয়ার্ড ব্লকের শক্ত ঘাঁটি। গত দুই বছর সেখানে বামবোর্ডে তাঁদেরই প্রধান ছিল। এ বারও থাকছে। ১৩টি আসনের মধ্যে ৪টিতে তারা, ৩টিতে সিপিএম জিতেছে। রানিগঞ্জ-পানিশালি গ্রাম পঞ্চায়েতে গত নির্বাচনে বাম বিরোধী মহাজোট বোর্ড দখল করেছিল। প্রথমে কংগ্রেসের প্রধান এবং পরে নির্ধল প্রধান হন। এ বার ওই গ্রাম পঞ্চায়েতেই যে টুকু ভাল ফল হয়েছে তৃণমূলের। ২৭টি আসনের মধ্যে তারা ১২টি আসনে জিতে একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। তবে সিপিএম ৭টি আসনে, সিপিআই একটিতে, বিজেপি ২টি আসনে জিতেছে। ৪টি আসনে নির্দল প্রার্থীরা জিতেছেন। তাদের পিছনে মূলত বামেদের সমর্থনই রয়েছে। একটি আসনে জিতেছে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। ওই গ্রাম পঞ্চায়েত ত্রিশঙ্কু অবস্থায় রয়েছে। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে ১টি আসনও পায়নি কংগ্রেস। অথচ গত নির্বাচনেও ৪টি আসন পেয়েছিল তারা। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোটের আগে কংগ্রেস-তৃণমূল গোলমালে কংগ্রেসের এক মহিলা প্রার্থীকে পুলিশ রাতে বাড়িতে ঢুকে বিছানা থেকে চুলের মুঠি ধরে বের করে গ্রেফতার করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। তা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ফলাও করে প্রচার চালিয়েও কংগ্রেস নিজেদের পালে হাওয়া লাগাতে পারেনি।
বরং স্বাধীনতার পর থেকে ৩৪ বছরে বাম শাসনেও যে খড়িবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত বরাবর কংগ্রেসের দখলে ছিল, যে গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে কংগ্রেসের রাজ্য নেতারা গর্ব করতেন, এবং এবারও সেখানে জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন, সেখানে কংগ্রেসের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। শাসক বিরোধিতায় নেমে ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে কংগ্রেস। সেখানে ১৭ টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৩টিতে জিতেছে। এই নির্বাচনে ওই গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে নিয়েছে সিপিএম। তা দেখে বামেরা নিজেরাই হতবাক। সিপিএমের জোনাল কমিটির সম্পাদক রামকুমার ছেত্রী বলেন, ‘‘আমরা ভাল ফল করব প্রত্যাশাই ছিল। এ দিন ফলাফল দলের কর্মী সমর্থকদের নতুন করে জাগিয়ে দিল।’’
তৃণমূলকে আটকালেও নিজেদের জায়গা হারানোয় হতাশ কংগ্রেস শিবির। গত নির্বাচনে জেতার পর কংগ্রেস ওই গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠন করেছিল। প্রধান হয়েছিল পরিমল সিংহ। ব্লক সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ নাথ। বোর্ডের শেষের দিকে তাঁরা সদলবলে তৃণমূলে যোগদান করেন। কংগ্রেসের ওই এলাকা দেখভাল করতেন যে নেতা বিকাশ সরকার, তিনিও ভোটের কিছু আগে তৃণমূলে যোগ দেন। ওই অঞ্চলে তৃণমূলের পর্যবেক্ষক ছিলেন বিকাশবাবুই। অরবিন্দবাবু দল বদল করে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি হয়েছেন। তবে ভোটে জিততে পারেননি তিনিও।