গাংনাপুরের কনভেন্ট স্কুলে ডাকাতি ও বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সোমবারই রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে। এ বার সক্রিয় হলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের পক্ষে টুইট করে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ঘটনায় মোদী উদ্বিগ্ন। তিনি এ ব্যাপারে রাজ্যের কাছে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছেন। রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা-ও জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
শুক্রবার গভীর রাতে রানাঘাটের ওই স্কুলে সাত দুষ্কৃতী ঢুকে যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা প্রকাশ্যে আসতেই কার্যত গোটা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তৎপর হয় কেন্দ্রও। নর্থ ব্লকের খবর, এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে নবান্নর কাছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা রুখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের স্তরেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ না রেখে আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন প্রধানমন্ত্রী নিজে।
এর ফলে গোটা ঘটনাটি অন্য মাত্রা পেতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, বৃদ্ধা খ্রিষ্টান সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণ করার ঘটনাটি শুধু রাজ্যেরই নয়, গোটা দেশের মুখ পুড়িয়েছে। এমনিতেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির কিছুটা সমস্যা রয়েছে মোদী সরকারের। এমনকী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এ ব্যাপারে মোদী সরকারকে বিঁধতে ছাড়েননি।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা অবশ্য চলছেই। ইতিমধ্যে দিল্লির মিশনারি স্কুলে হামলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রার্থনালয় আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপর্যয়ের পিছনে এই প্রবণতা অন্যতম কারণ বলে অনেকে বলছেন। এই পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়াটা মোদীর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যেও পড়ে। ইতিমধ্যেই তৃণমূলের তরফ থেকে অভিযোগ করা শুরু হয়ে গিয়েছে, পুর নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাটিতে বিজেপির হাত রয়েছে। লোকসভায় আজ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ও এই হামলার জন্য বিজেপিকে নাম করে দুষেছেন। দলের অন্য সাংসদরাও একই সুরে গাইছেন। তদন্তের আগেই এই দোষারোপের রাজনীতিতে মোদীও যে রুষ্ট হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সে জন্যই তাঁর দফতর রাজ্য সরকারের কাজে জবাবদিহি তলব করেছে ঘটনার পরে কী করছে তারা!
সংসদের গত অধিবেশন কার্যত ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল সংঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের হিন্দুত্ববাদী মন্তব্য ও ধর্মান্তরণ বিতর্কে। এই নিয়ে রাজ্যসভায় অচলাবস্থা তৈরি হয়, আটকে যায় বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল। এ বারের বাজেট অধিবেশন শুরু হওয়ার ঠিক আগে মোদী তাই ধর্মীয় সহনশীলতার ডাক দেন। তার ঠিক এক মাসের মধ্যেই শুক্রবার রানাঘাটের ঘটনা।
তবে এই ঘটনাই প্রথম নয়। রাজ্যে পালাবদলের পর গত প্রায় চার বছরে নারী নির্যাতন-সহ ২৪টি অপরাধের ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানতে চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে রাজ্যকে গত দু’মাসে তিনটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। শেষ চিঠিটি এসেছে ১২ মার্চ। কিন্তু তা নিয়ে কোনও সাড়াশব্দ করেননি নবান্নের কর্তারা।
কোথাও পিটিয়ে হত্যা, কোথাও ধর্ষণ করে খুন, আবার কোথাও মহিলার অসম্মান রুখতে গিয়ে খুন হতে হয়েছে ভাই অথবা প্রতিবাদী যুবককে। এই সব ঘটনার প্রতিবাদে পথে নেমেছেন মানুষ। ‘আক্রান্ত আমরা’ নামে সংগঠনের পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল। প্রায় সব বিরোধী দল রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রশাসন কড়া পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলেই অভিযোগ। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে এ দিনও সংসদে অভিযোগ করেছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম ও কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী।
নবান্ন সূত্রের খবর, প্রথমে ১২ জানুয়ারি, পরে ১২ ফেব্রুয়ারি নবান্নে চিঠি পাঠিয়ে সরকারের কাছে কার্যত জবাবদিহি চায় কেন্দ্র। সেই সঙ্গে প্রতিটি ঘটনা মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ করার পরামর্শও দেওয়া হয়। নবান্নের কর্তারা দু’টি চিঠির জবাব না দেওয়ায় গত ১২ মার্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবের কাছে আবার চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাতে এ-ও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য ওই ঘটনাগুলি সম্পর্কে রাজ্যের বক্তব্য জানাটা জরুরি। রাজ্য প্রশাসনের একাংশের মতে, চিঠিতে রাষ্ট্রপতির কথা উল্লেখ করে নবান্নের কর্তাদের কার্যত কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। চিঠির বয়ান থেকে স্পষ্ট, রাষ্ট্রপতিকে সঠিক তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় যে রাজ্য সরকার, সেই কথাটাই বলার চেষ্টা হয়েছে।
কেন রাজ্যের এই অনীহা? উত্তর দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকেরই এক কর্তা। সচিব পর্যায়ের ওই কর্তার কথায়, “ঘটনাগুলি নিয়ে রাজ্য প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে উত্তর পাঠাতে সময় নিত না। যে হেতু ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু নেই, তাই চিঠির জবাব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু যত দিন উত্তর না পাব, তত দিন চিঠি পাঠিয়ে যাব।”
কেন্দ্রের প্রাথমিক অনুমান, এটি নিছক ডাকাতির ঘটনা নয়। সন্ন্যাসিনীকে কেন নিশানা করা হল, সেই বিষয়টিই ভাবাচ্ছে মোদী সরকারকে। সচিবালয় সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককেও নির্দেশ দিয়েছেন মোদী।
রাজ্য অবশ্য মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি ভাবে দিল্লিকে কিছু জানায়নি। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক বিভাগের পক্ষ থেকে রানাঘাটের ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তা পাঠাতে আরও দু’তিন দিন সময় লাগবে। কারণ তদন্তের কাজ চলছে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে বলার মতো তথ্য হাতে আসেনি। তাই দিল্লির কাছে রিপোর্ট পাঠাতে কিছু সময় লাগবে। তবে মৌখিক ভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (আইবি)-কে ঘটনাটি জানানো হয়েছে। নবান্নের খবর, ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠিকেও একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছে রাজ্য প্রশাসন।