অম্লরোষ/ ১

পৌরুষের অ্যাসিডে পুড়ে যায় প্রিয় মুখ

দেশের আনাচকানাচ জুড়ে অজস্র অ্যসিড দগ্ধ মুখ। গাঁ-গঞ্জের হবিবপুর, হাঁসখালি, নওদাও সেই মানচিত্রে একে অপরকে ছুঁয়ে আছে যেন। কিন্তু, কোথা থেকে আসে সেই অ্যাসিড, কেনই বা পুড়ে যায় উনিশ থেকে উনচল্লিশের মুখগুলো, কী বিচারই বা ফিরে পান তাঁরা—খোঁজ নিল আনন্দবাজার।শাস্তির নাম অ্যাসিড! বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি মেয়ে, সাহস তো কম নয়? অতএব, ভরা সাঁঝে ঘরমুখো মেয়েটির মুখে উড়ে এসেছিল অ্যাসিড।ভাব-ভালবাসায় না, মেলামেশায় অরাজি, আর বিয়ে তো নয়ই— এ সব ‘না’-এ কি পুরুষ মানে?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৪০
Share:

শাস্তির নাম অ্যাসিড!

Advertisement

বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি মেয়ে, সাহস তো কম নয়? অতএব, ভরা সাঁঝে ঘরমুখো মেয়েটির মুখে উড়ে এসেছিল অ্যাসিড।ভাব-ভালবাসায় না, মেলামেশায় অরাজি, আর বিয়ে তো নয়ই— এ সব ‘না’-এ কি পুরুষ মানে? অতএব, কখনও ছুটন্ত সাইকেল থেকে কখনও বা বাড়ির টালির ছাদ ফুঁড়ে ছিটকে আসে অ্যাসিড, পৌরুষে পুড়ে যায় মুখ।দেশ জুড়ে এই ঘটনা আকছার। ‘না’- এ অপমানিত পুরুষ তাই ক্রমাগত পুড়িয়ে চলেছে মুখ।

সেই তালিকায় উঠে আসছে সুতি থেকে করিমপুর, চাকদহ থেকে নওদা, হাঁসখালি থেকে হবিবপুর। মোকিমা, সুজাতা, হাসিনা— এমনই ‘না’-এর বদলে পোড়ামুখ নিয়ে ক্ষতবিক্ষত জীবনে শাস্তি বয়ে চলেছেন তাঁরা। বিচার? না, তেমন নজির বিরল। অক্টোবরের ১০ তারিখ। অনেক রাত। হাঁসখালির গাজনা দক্ষিণপাড়ায় বিছানা তাক করে ছোড়া অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছিল গাজনা হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী মৌ রজক ও তার মায়ের দেহ। সোমবার ভোর রাতে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় ওই ছাত্রীর।

Advertisement

এই ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু তারপর?গোলটা বাধছে এখানেই। অ্যাসিড হামলা, থানা-পুলিশ, সংবাদমাধ্যম, ধরপাকড়, আইন-আদালত সবই হচ্ছে। কিন্তু দোষীরা কি সাজা পাচ্ছে?

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো ও অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার হিসেব অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ১৩১টি অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটেছে। অথচ সাজা হয়েছে মাত্র একজনের! বছর ছয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর স্টেশন চত্বরে অ্যাসিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক যুবতী। পরে তাঁকে অপহরণ করে দিনের পর দিন ধর্ষণও করা হয়। দু’টি অপরাধের দায়ে গত সেপ্টেম্বরে বছর পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে বারাসত আদালত। এমন সাজা অবশ্য কালেভদ্রেই হয়।

কিন্তু ওই পর্যন্তই! আর অন্য ঘটনায় বাকি অভিযুক্তেরা কেউ জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। আর হাতেগোনা কয়েক জন জেল হাজতে রয়েছে। অথচ ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৬এ (অ্যাসিড এবং ওই জাতীয় দাহ্য ছোড়া) এবং ৩২৬বি (অ্যাসিড বা ওই জাতীয় দাহ্য ছোড়ার চেষ্টা) ধারায় অভিযুক্তের ন্যূনতম সাত বছর এবং সর্বাধিক দশ বছর জেল হতে পারে। দু’টি ধারাই জামিনঅযোগ্য।

সম্প্রতি অ্যাসিড ছুড়ে প্রীতি রাঠি নামে এক মহিলাকে খুন করার অপরাধে অঙ্কুর পানওয়ার নামে এক যুবককে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়েছে মহারাষ্ট্রের একটি বিশেষ মহিলা আদালত। আদালতের পর্যবেক্ষণ, অ্যাসিড আক্রমণের হিংস্রতা ধর্ষণের থেকেও মারাত্মক। ধর্ষণের ক্ষেত্রে মহিলাটি নিজের পরিচয় গোপন করে নিরাপদ কোনও আশ্রয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু অ্যাসিড আক্রান্তকে সেই দগ্ধ শরীর নিয়েই বাইরে বেরোতে হয়।

মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি দিল্লি, অন্ধ্রপ্রদেশেও অ্যাসিড হামলার ঘটনায় সাজা পেয়েছে অভিযুক্তেরা। কিন্তু এ রাজ্যে পাঁচ বছরে সাজাপ্রাপ্তের সংখ্যা মাত্র একটি! এমন অবস্থা কেন? অ্যাসিড আক্রান্ত ও তাঁদের জন্য কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনগুলো এর পিছনে পুলিশ প্রশাসনের উদাসীনতাকেই দুষছেন।

তাঁদের অভিযোগ, অ্যাসিডের ব্যাপারে পুলিশের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের কারণেই অভিযুক্তেরা সাজা পাচ্ছে না। তাছাড়া অ্যাসিড নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত উদ্বিগ্ন প্রকাশ করেছেন বার বার। ক্ষতিপূরণের টাকা ও সাজার মেয়াদ বাড়িয়েছে। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে অ্যাসিড বিক্রির উপরেও।

তারপরেও গঞ্জ থেকে শহর সর্বত্র এত সহজে অ্যাসিড মিলছে কী করে?

(তথ্য: বিমান হাজরা, সুস্মিত হালদার, সৌমিত্র সিকদার, সেবাব্রত মুখোপাধ্যায় ও কল্লোল প্রামাণিক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement