উড়ালপুল-মামলা

ঠোকাঠুকি দুই বিচারপতির, কোর্ট আগুন

বিচারপতি ক্ষোভে ফুঁসছেন। গমগমে স্বরে যেন কেঁপে উঠছে আদালতকক্ষ। হাত জোড় করে তাঁকে শান্ত হতে বলছেন কৌঁসুলিরা। ওঁর ক্রোধের লক্ষ্য অবশ্য কোনও আইনজীবী বা আসামি নন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০৪:১৩
Share:

অসীম রায় ও সিএস কারনান

বিচারপতি ক্ষোভে ফুঁসছেন। গমগমে স্বরে যেন কেঁপে উঠছে আদালতকক্ষ। হাত জোড় করে তাঁকে শান্ত হতে বলছেন কৌঁসুলিরা।

Advertisement

ওঁর ক্রোধের লক্ষ্য অবশ্য কোনও আইনজীবী বা আসামি নন। এজলাসে উপস্থিত কোনও দর্শকের আচরণে বিরক্ত হয়েছেন, এমনও নয়। ডিভিশন বেঞ্চের সতীর্থ বিচারপতির আচরণেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তিনি। খানিক বাদে সতীর্থও মুখ খুললেন। বিতণ্ডার সুর চড়ল। শেষে দু’জনেই চলে গেলেন এজলাস ছেড়ে।

দুই বিচারপতির তীব্র মনোমালিন্য ও ভরা এজলাসে তার বহিঃপ্রকাশের সাক্ষী থাকল মঙ্গলবারের কলকাতা হাইকোর্ট। যার মূলে উড়ালপুল-কাণ্ডে ধৃতদের জামিন-মামলা। জল এতটাই গড়িয়েছে যে, মাদ্রাজ হাইকোর্ট থেকে সদ্য কলকাতায় বদলি হয়ে আসা বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনানকে অনির্দিষ্ট কাল বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। ক’দিন আগে রেড রোড-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত সাম্বিয়া সোহরাবের জামিন-প্রশ্নেও হাইকোর্টে ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতির মধ্যে মতবিরোধ হয়েছিল। এ দিনের ঘটনা তাকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলে আইনি মহলের একাংশের দাবি।

Advertisement

এবং দু’দিনের মূল দুই চরিত্র একই— বিচারপতি অসীম রায় ও বিচারপতি চিন্নাস্বামী স্বামীনাথন কারনান। ব্যাপারটা কী?

কোর্ট-সূত্রের খবর: এর সূত্রপাত ২০ মে। বিবেকানন্দ রোড উড়ালপুল বানাচ্ছিল যারা, সেই ‘আইভিআরসিএল’-এর ডিরেক্টর-সহ দশ আধিকারিকের জামিনের শুনানি ছিল সে দিন। বিচারপতি রায় ও বিচারপতি কারনানের বেঞ্চে মামলাটি ওঠে। সওয়াল-জবাব শেষে বিচারপতি রায় জানিয়ে দেন, তিনি জামিন-আর্জি খারিজ করছেন। সরকারপক্ষের দাবি: বিচারপতি কারনানও তখন অভিযুক্তপক্ষের কৌঁসুলিদের জানিয়ে দেন, তিনি একমত। পর দিন থেকে হাইকোর্টে গরমের ছুটি। তাই বিচারপতি রায় তাঁর অর্ডারে সই করে বিচারপতি কারনানের চেম্বারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

সূত্রের খবর: বিচারপতি কারনান সে দিন অর্ডারে সই করেননি। তিনি মামলার কেস ডায়েরি বাড়ি নিয়ে যান। সোমবার আদালত খুললে তিনি কেস ডায়েরি বেঞ্চে পাঠিয়ে নির্দেশ দেন, এজলাস ছাড়ার আগে যেন তাঁকে দিয়ে অর্ডারে সই করিয়ে নেওয়া হয়। তা করাও হয়।কিন্তু এর পরে সব অন্য দিকে মোড় নেয়। সূত্রের খবর: কিছুক্ষণ বাদে অর্ডারে নিজের সই কেটে দিয়ে এজলাস ছেড়ে উঠে যান বিচারপতি কারনান। আর সন্ধ্যায় অফিসার মারফত বিচারপতি রায়কে জানিয়ে দেন, তিনি জামিনের পক্ষে। তাই নতুন করে অর্ডার লিখে পাঠাবেন!

ডিভিশন বেঞ্চের অন্দরে বিবাদের ছায়া ঘনাতে দেরি হয়নি। যা প্রকাশ্যে চলে এল এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ বসতেই। বেলা সওয়া এগারোটায় এজলাসে এসে বিচারপতি রায় পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজিৎ সিংহকে নির্দেশ দেন, অবিলম্বে অভিযুক্তপক্ষের কৌঁসুলিদের হাজির করা হোক। পরক্ষণেই শুরু হয় তাঁর ক্ষোভের উদ্গীরন। ‘‘এনাফ ইজ এনাফ! তিন-তিন বার হল। অনেক সহ্য করেছি।’’— মন্তব্য করেন বিচারপতি রায়। পিপি’কে বলেন, ‘‘বার অ্যাসোসিয়েশন, বার লাইব্রেরি, ইনকর্পোরেটেড ল’ সোসাইটি-র কর্তাদের ডেকে আনুন। অ্যাডভোকেট জেনারেলকে ডাকুন। ওঁরা এসে জেনে যান, এই ডিভিশন বেঞ্চে কী চলছে!’’

বিচারপতি কারনান তখনও চুপ করে বসে। অন্য দিকে রীতিমতো তপ্ত স্বরে বিচারপতি রায় বলে চলেছেন, ‘‘ভালমানুষিকে দুর্বলতা ভাবা ভুল। এ পশ্চিমবঙ্গ। এটা কলকাতা হাইকোর্ট। দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী হাইকোর্ট। এখানে যা খুশি চলতে দেওয়া যায় না।’’

পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। পিপি মনজিৎ সিংহ বিচারপতি রায়কে করজোড়ে বলেন, ‘‘আপনি শান্ত হোন। অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’’ পাশাপাশি বিচারপতি কারনানের উদ্দেশে পিপি ছুড়ে দেন প্রশ্ন— ‘‘বিচারপতি রায়ের সঙ্গে আপনার মত মিলতে না-ই পারে। তা হলে ২০ তারিখেই জানালেন না কেন? সে দিন তো আপত্তিও করেননি! তবে অর্ডারে সই করে কেন কেটে দিলেন?’’

ইতিমধ্যে অভিযুক্তপক্ষের কৌঁসুলি শেখর বসু এজলাসে ঢোকেন। তাঁর উদ্দেশে বিচারপতি রায়ের সখেদ মন্তব্য— ‘‘আপনাদের সে দিন জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, জামিন মঞ্জুর হচ্ছে না। অথচ আমার সঙ্গে আলোচনা না-করেই উনি (বিচারপতি কারনান) মর্জিমাফিক নতুন অর্ডার লিখছেন!’’

এ বার মুখ খোলেন বিচারপতি কারনান। ‘‘পরে আমার মনে হয়েছে, অভিযুক্তেরা জামিন পাওয়ার
যোগ্য। তাই সই কেটে দিয়েছি।’’— ব্যাখ্যা দেন তিনি। শুনে বিচারপতি রায় দৃশ্যত আরও রেগে যান। কড়া কড়া বাক্যবাণ ছুড়ে দিতে থাকেন সতীর্থের দিকে। ততক্ষণে হাইকোর্টের আনাচে-কানাচে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুরঞ্জন দাশগুপ্ত-সহ প্রবীণ আইনজীবীরা চলে আসেন। তাঁরাও হাত জোড় করে বিচারপতি রায়কে শান্ত হতে বলেন। ওঁদের অনুরোধে বেলা পৌনে বারোটা নাগাদ বিচারপতি রায় উঠে যান। বিচারপতি কারনানও এজলাস ছাড়েন।

এ হেন ঘটনার জেরে বিচারপতি কারনানকে বয়কট করতে চলেছেন আইনজীবীরা। এ দিন বিকেলে হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘‘ওঁকে নিয়ে আগেও সমস্যা হয়েছে।’’— অভিযোগ সুরঞ্জনবাবুর। নিজের বদলি নিয়ে স্থগিতাদেশ জারি করে শিরোনামে এসেছিলেন কারনান। রাজ্য বার কাউন্সিলের সহ সভাপতি প্রসূন দত্তের কথায়, ‘‘বিচারপতি কারনান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নির্দেশও মানতে চাননি! আমরা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসে গিয়ে অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলাম, ওঁকে যেন কলকাতায় পাঠানো না হয়।’’

যে মামলা ঘিরে এত কাণ্ড, তার ভবিষ্যৎ কী?

আইনজীবীদের একাংশের পর্যবেক্ষণ, দুই বিচারপতির মতভেদের কারণে জামিন-মামলাটি এ বার অন্য ডিভিশন বেঞ্চে যেতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন