খয়রাশোলের পাঁচড়া মোড়ে তৃণমূলের অবরোধে স্তব্ধ রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
অশোক মুখোপাধ্যায় খুনের জেরে প্রায় ছ’ঘণ্টা ধরে জাতীয় সড়ক অবরোধ করলেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। তার জেরে দীর্ঘক্ষণ যানজটে নাজেহাল হলেন যাত্রীরা। শেষমেশ পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ উঠলেও ততক্ষণে যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে!
শনিবার রাতে তৃণমূলের প্রাক্তন খয়রাশোল ব্লক সভাপতি খুনের পর থেকে ফের আরও একবার অশান্ত হয়ে উঠেছে খয়রাশোল। গত বছর ১২ অগস্ট খয়রাশোলে তৃণমূলের আর এক প্রাক্তন ব্লক নেতা অশোক ঘোষকেও একই কায়দায় খুন করা হয়েছিল। তার খুনের পরেও একই ভাবে এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। ওই খুনের ঘটনায় অবশ্য নিহতের পরিবার অশোক মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। আগের বারের মতোই শনিবার রাত থেকে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে অশোক মুখোপাধ্যায়ের অনুগামী ও পরিবারের সদস্যদের মধ্য। পুলিশকে দেহ তুলতে বাধা দেওয়া হয়। তাঁদের দাবি, আগে আততায়ীদের গ্রেফতার করতে হবে। নইলে দেহ ছাড়া হবে না। পুলিশ ওই প্রবল বিরোধিতার মুখে রাতভর দেহ সরাতে কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি। বিক্ষোভকারীরা প্রকাশ্যেই দাবি করতে থাকেন, দলেরই অন্য একটি গোষ্ঠী (অশোক ঘোষ গোষ্ঠী) ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাঁর খুনের বদলা নিতে তথা এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতেই এই খুন বলে তাঁরা অভিযোগ করতে থাকেন। সরাসরি কিছু না বললেও কার্যত প্রায় একই দাবি নিহত নেতার ভাই রজত মুখোপাধ্যায় ও দিদি কৃষ্ণা অধিকারীরও। ক্ষোভে-দুঃখে ডেপুটি পুলিশ সুপার (সিউড়ি সদর) পার্থ ঘোষের শত অনুরোধেও তাঁরা কেউ-ই অশোকবাবুর দেহ ময়না-তদন্তের জন্য নিয়ে যেতে দেননি।
স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশের বাধায় রবিবার আবার বিপর্যয়ে পড়েন রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের যাত্রীরা। নেতা খুনে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করার দাবিতে তাঁর ওই অনুগামীরা ভোর সাড়ে ৫টা থেকে স্থানীয় পাঁচড়া মোড় জাতীয় সড়ক অবরোধ শুরু করেন। অবরোধ করা হয় স্থানীয় পাঁচড়া-বাবুইজোড় সড়কও। দু’পাশে সার দিয়ে যানবাহন আটকা পড়তে থাকে। ঘণ্টা দু’য়েক যেতে না যেতেই এলাকায় বিশাল যানযটের সৃষ্টি হয়। সাড়ে ৮টা নাগদ বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়।
এ দিকে, তখনও পরিজনেরা ওই ফলের দোকানে নিহত নেতার দেহ আটকে রেখেছেন। দেহ ঘিরে ক্রমে ভিড় আর কান্না বাড়তে থাকে। অশোকবাবুর অসুস্থ স্ত্রী তৃপ্তিদেবীকে (আগামী মঙ্গলবারই তাঁকে নিয়ে অশোকবাবুর চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল) তখনও দুঃসংবাদ দেওয়া হয়নি। নিহত নেতার বড় ছেলে সৌরভ মুখোপাধ্যায় (পেশায় সিউড়ি থানার গ্রামীণ পুলিশ কর্মী) এবং বাঁধেরশোল পলিটেকনিকের ছাত্র, ছোটছেলে বিশ্বজিত্ মনমরা হয়ে ঘুরছেন। দু’জনের কেউ-ই কারা বাবাকে খুন করল, তা নিয়ে মুখ খুললেন না। শুধু বললেন, “দলীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসনের উপর আস্থা রয়েছে।” তা হলে কেন রাস্তা অবরোধ বা দেহ আগলে রাখা? কোনও জবাব দেননি দু’ভাই।
জাতীয় সড়ক অবরোধের খবর পেয়ে তত ক্ষণে এলাকায় পৌঁছে যান দলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়। তিনি স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বোঝাতে থাকেন, এ ভাবে দেহ আগলে রাখলে পচন ধরবে। ময়না-তদন্ত করাতে চূড়ান্ত অসুবিধা হবে। মলয়বাবু দাবি করেন, জেলা সভাপতিও (অনুব্রত মণ্ডল) চান দেহ ছেড়ে দেওয়া হোক। এতেই কাজ হয়। পুলিশের সঙ্গে একপ্রস্থ আলোচনাও হয়। খয়রাশোলের ওসি দেবব্রত সিংহ প্রথমে জানান, দেহ থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। পরে ঠিক হয়, দেহটি একেবারেই সিউড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিবারের মহিলা সদস্যেরা দেহ ছাড়তে মৃদু আপত্তি করলেও পরে তাঁরাও মেনে নেন। তত ক্ষণেও জাতীয় সড়কের অবরোধ ওঠেনি। তাই সিদ্ধান্ত হয়, জাতীয় সড়ক ধরে না নিয়ে গিয়ে পাঁচড়া থেকে খয়রাশোল, বক্রেশ্বর হয়ে সিউড়ি সদর হাসপাতালে দেহ নিয়ে যাওয়া হবে।
সকাল ১১টা নাগাদ দেহটি সিউড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও অবশ্য অবরোধ ওঠেনি। এমনকী, পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বিশাল পুলিশ বাহিনী থাকলেও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অবরোধ তুলতে প্রথমে শক্তি প্রয়োগ করার সাহস দেখাননি। অবরোধকারীরা আততায়ীদের গ্রেফতারির দাবিতে অনড় থাকায় অবরোধ জারি থাকে। ফলে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়েন ওই রাস্থায় যাতায়াতকারীরা। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বিরক্ত হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়। তিনি বলেন, “আপনারা আপনাদের কাজ করুন। আমরা আমাদের কাজ করছি।” ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ সংবাদমাধ্যম খয়রাশোল ছাড়লে পুলিশ লাঠিচার্জ করে অবরোধ তুলে দেয়। ময়না-তদন্ত হওয়ার আগে সিউড়িতে দলের কার্যালয়ে অশোকবাবুর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিহত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। ময়না-তদন্তের পরে সন্ধ্যায় বক্রেশ্বর শ্মশানে নিহত নেতার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।