হেলমেট নেই কারও মাথায়। পুলিশ ছিল দর্শক। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র
নির্দেশটা দিয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। যিনি কিনা তৃণমূলের সর্বোচ্চ নেত্রীও বটে। অথচ বৃহস্পতিবার তৃণমূলেরই সভায় যাওয়া-আসার পথে বহু দলীয় কর্মী তা ফুৎকারে ওড়ালেন। আবার নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী যথোচিত ব্যবস্থা নিতে বলা সত্ত্বেও পুলিশ নিল না। বা, নিতে পারল না।
প্রসঙ্গ: দু’চাকায় হেলমেট। বৃহস্পতিবার একুশের জনস্রোতে উপচে পড়া রাজপথে নানা জায়গায় চোখে পড়েছে বেপরোয়া বিধিভঙ্গ। যেমন, বেলা বারোটা নাগাদ পার্ক স্ট্রিট-ক্যামাক স্ট্রিটের মোড়ে। তৃণমূলের পতাকা লাগানো একটি মোটরবাইকে তিন জন, কারও মাথায় হেলমেট নেই। তার উপরে চালকের বিপজ্জনক কেরামতি। এক সার্জেন্ট গিয়ে বললেন, ‘‘কী হচ্ছে? হেলমেট কোথায়?’’ ভয় পাওয়া দূর, উল্টে সার্জেন্টের উদ্দেশে আরোহীরা ছুড়ে দিলেন তির্যক মন্তব্য— ‘‘আরে, কমরেড পুলিশ রে! আমাদের ধরছে।’’
ওঁরা যাচ্ছিলেন ধর্মতলায় ‘শহিদ দিবস’-এর সমাবেশে। আগে-পিছে মিছিলের সারি। বচসা শুনে অন্য কিছু পতাকাধারী এগিয়ে এলেন। প্রায় সকলের মুখেই এক রা— সার্জেন্ট সিপিএমের লোক, তাই হেনস্থা করছেন।
শেষমেশ কয়েক জন অফিসার গিয়ে সামাল দিলেন। কথা না-বাড়িয়ে মোটরসাইকেল ছেড়ে দেওয়া হল। একই ভাবে বৃহস্পতিবার হেলমেটহীন সওয়ারি নিয়েও বহু দু’চাকা পার পেয়ে গিয়েছে। কলকাতা তো বটেই, সল্টলেক, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি— সর্বত্র। কলকাতা লাগোয়া বিভিন্ন জেলা থেকে দলে দলে তৃণমূল কর্মী-সমর্থক মোটরসাইকেল-স্কুটারে চড়ে ধর্মতলায় গিয়েছেন-এসেছেন। অনেকেই হেলমেটের ধার ধারেননি। তিন জন আরোহী বসিয়েও এন্তার ছুটেছে মোটরবাইক।
ঘটনা হল, স্বয়ং মমতাই দু’চাকায় হেলমেট বাধ্যতামূলক করার আদেশ দিয়েছেন। সেই মতো কলকাতা পুলিশ চালু করেছে ‘হেলমেট নেই, পেট্রোল নেই’ নীতি। একুশের মঞ্চ থেকেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘হেলমেট ছাড়া বাইক চালাবেন না। চার দিকে এত দুর্ঘটনা ঘটে, আমার ভাল লাগে না।’’
কিন্তু নেত্রীর অপছন্দের কাজটাই অনুগামীরা যে ভাবে পাইকারি হারে করে দেখালেন, আর পুলিশ যে ভাবে হাত গুটিয়ে রইল, তাতে সংশয় জাগছে। প্রশ্ন উঠছে— নির্দেশটা তা হলে কি শুধু আমজনতার জন্য? সওয়ারি তৃণমূলকর্মী হলে কিংবা দু’চাকায় শাসকদলের ঝান্ডা লাগানো থাকলে সব মাফ?
কলকাতা পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) ভি সলোমন নেসাকুমার অবশ্য এমনটা মনে করেন না। ‘‘নিয়ম ভাঙা সকলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আইনমাফিক জরিমানা হবে।’’ পুলিশকর্তাদের বক্তব্য, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এত বড় সমাবেশের সময়ে যান চলাচল, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ধরে ধরে মোটরবাইক আটকাতে গেলে আইন-শৃঙ্খলায় সমস্যার আশঙ্কা থাকে। হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) সুমিত কুমারও বলছেন, ‘‘হাজার হাজার লোকের মিছিলের মধ্যে মোটরবাইক ধরে কেস দিতে গেলে আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হতে পারত।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তারও যুক্তি তা-ই। হুগলি জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘বৃহস্পতিবার পুলিশের উপরে বিপুল চাপ ছিল। হেলমেট পরা না-পরার ব্যাপারটা দেখার সুযোগ হয়নি।’’
তা হলে শাস্তি হবে কী ভাবে?
‘‘পরে সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।’’— মন্তব্য করেছেন লালবাজারের এক অফিসার। বিধাননগর কমিশনারেটেরও একই দাবি। যদিও ওই তল্লাটে সব জায়গায় সিসিটিভি নেই। যেগুলো আছে, তার বড় অংশ অকেজো।
অর্থাৎ, সংশয়ের নিরসন পুরোপুরি হচ্ছে না। বস্তুত তৃণমূল যুব সংগঠনের সভাপতি তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনাপ্রবাহে যারপরনাই বিরক্ত। খাতায়-কলমে দলের যুব সংগঠনই একুশের আয়োজক। তার সর্বোচ্চ নেতা তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক মনে করেন, হেলমেট না-পরে মোটরবাইকে চড়ে সমাবেশে আসা কারও উচিত হয়নি। ওঁর কথায়, ‘‘হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানো ঠিক নয়। ট্রাফিক আইন সকলকে মানতে হবে। প্রত্যেকের আরও দায়িত্ববান হওয়া জরুরি।’’