প্রায় তৈরি নতুন ভবনের সামনে মকরামপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বসানো হয়েছে সচিনের সাংসদ কোটার টাকা প্রাপ্তি স্বীকার সংক্রান্ত বোর্ডটি।—নিজস্ব চিত্র
কলকাতা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক অজ গ্রাম। আর সেখানেই রাস্তার ধারে স্কুলবাড়ির সামনে লাগানো একটি সাদামাটা টিনের কালো বোর্ড।
বোর্ডের লেখা পড়লে কিন্তু চোখ কপালে উঠবে!
গোটা গোটা ইংরেজি হরফে সাদা কালিতে লেখা: রাজ্যসভার মাননীয় সাংসদ সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের সাংসদ-তহবিলের টাকায় তৈরি হচ্ছে এই স্কুলবাড়ি।
স্কুলের নাম গোবিন্দপুর-মকরামপুর স্বর্ণময়ী শাসমল শিক্ষানিকেতন। নারায়ণগড়ের মকরামপুরে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে এই স্কুলেই সচিনের তহবিলের টাকায় হচ্ছে নতুন ভবন।
কিন্তু এ তো প্রায় অসম্ভব! সচিন মানে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা ক্রিকেট দুনিয়ার উজ্জ্বলতম তারা। তাঁর সঙ্গে এ রাজ্যের তেমন কোনও যোগও নেই। তা হলে মেদিনীপুরের এই অজ গাঁয়ে তাঁর সাহায্য এল কী করে? সৌজন্যে উত্তমকুমার মহান্তি। মকরামপুরের ওই উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। খেলার মাঠের লোক না হয়েও যে মাস্টারমশাই ‘মাস্টার স্ট্রোক’ হাঁকিয়েছেন। নিজের স্কুলের জন্য অর্থসাহায্য আদায় করেছেন একেবারে ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-এর কাছ থেকে।
এ ক্ষেত্রে নিয়মকানুনের অবশ্য বাধা নেই। রাজ্যসভার সাংসদ চাইলে দেশের যে কোনও প্রান্তেই উন্নয়নের জন্য অর্থ সাহায্য করতে পারেন। আর সচিনের ক্ষেত্রে রাজ্যগত সীমানার নৈতিক বাধ্যবাধকতাও নেই। কারণ, তাঁকে রাজ্যসভায় মনোনীত করেছেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং।
এ কথা জেনেছিলেন উত্তমবাবু। আর সেই ভরসাতেই সটান চিঠিটা লিখে ফেলেছিলেন তিনি, একেবারে সচিন তেন্ডুলকরকে। সেটা ২০১৩-র মার্চ। তার আগে অবশ্য স্থানীয় বিধায়ক, সাংসদের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে চিঁড়ে ভেজেনি। নারায়ণগড়ের তৎকালীন বিধায়ক সূর্যকান্ত মিশ্রের কাছে তো পৌঁছতেই পারেননি। আর স্থানীয় সাংসদ প্রবোধ পাণ্ডার কাছে গিয়ে শুনতে হয়েছিল, ‘‘দেখছি।’’ কিন্তু কে, কবে, কতটা দেখবেন, আদৌ দেখবেন কিনা, সংশয় ছিল উত্তমবাবুর। অথচ ১৯৬৫ সালে তৈরি পুরনো স্কুলবাড়ির তখন ঝরঝরে দশা। ভাঙা ছাদ দিয়ে জল পড়ে, যথেষ্ট ক্লাসঘর নেই। হাজার খানেক পড়ুয়ার সকলের বসার জায়গা হয় না।
বাংলার গাঁয়ের স্কুলে এ সব অবশ্য চেনা সমস্যা। কিন্তু তার সমাধানে একেবারে সচিনের মতো মানুষের দ্বারস্থ হওয়া— এমনটা তো সচরাচর ভাবনাতেও আসে না।
২০০৩ সালে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেওয়া উত্তমবাবু জানালেন, স্কুলের সমস্যা মেটানোর রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে মনে পড়েছিল সচিনের নাম। প্রধান শিক্ষকের কথায়, “সাহায্যের জন্য এখানে-ওখানে গিয়ে যখন সাড়া পাচ্ছি না, তখন হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি সচিনের মস্ত ফ্যান। তাই স্কুলের হাল ফেরাতে ওঁর কথা মনে হয়েছিল। নেট ঘেঁটে দেখেছিলাম রাজ্যসভার সাংসদ সচিন দেশের যে কোনও জায়গায় টাকা দিতে পারেন। শুধু আবেদনটা করতে হয়। নেটেই পাই ঠিকানা।’’ সময় নষ্ট না করে আবেদনটা করেই ফেলেন উত্তমবাবু। স্কুলের দুর্দশার কথা জানান ‘লিটল মাস্টার’কে।
দিন যায়, মাস যায়, জবাব আর আসে না। কিছুটা হতাশ হয়েই ফের স্থানীয় ভাবে টাকা সংগ্রহে উদ্যোগী হন উত্তমবাবু। অর্থ়সাহায্যের আবেদন করেন জেলা পরিষদের কাছে। তবে লাভ হয়নি। শেষমেশ ২০১৪ সালের অগস্টে স্কুলের ঠিকানায় পৌঁছয় একটি চিঠি। উত্তমবাবু বললেন, ‘‘তারিখটা মনে আছে, ৭ অগস্ট। খামটা হাতে পেয়েই বুঝেছিলাম ভাল খবর। তারপর চিঠি পড়ে দেখলাম, সচিন আমাদের স্কুলকে ৭৬ লক্ষ টাকা দেবেন।’’
প্রধান শিক্ষককে লেখা সচিনের চিঠি
২০১৫-’১৬ অর্থবর্ষে সাংসদ তহবিল থেকে নারায়ণগড়ের এই স্কুলের জন্য ৭৬ লক্ষ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছেন সচিন। তবে টাকা পেতে আরও কিছুটা সময় লাগে। ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে দু’দফায় স্কুলের অ্যাকাউন্টে জমা হয় ৫৭ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা, মোট বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ। সেই টাকাতেই নতুন স্কুলবাড়িতে তৈরি হচ্ছে গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার এবং মেয়েদের কমন রুম।
জেলায় জেলায় নতুন স্কুল-কলেজ, প্রত্যন্ত এলাকাতেও পড়ার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া তাঁর সরকারের অন্যতম সাফল্য বলে বারবার দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা ঠিক— যে সময় উত্তমবাবু স্কুলের জন্য টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করছেন, তখন নারায়ণগড়ের বিধায়ক, সাংসদ দুই-ই ছিলেন বামেদের। তবে তিনি যখন জেলা পরিষদের দ্বারস্থ হন, তখন কিন্তু সেখানে ক্ষমতায় চলে এসেছে তৃণমূল। তা-ও টাকা মেলেনি। কেন? জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্রের জবাব, “প্রচুর স্কুল আবেদন করে। তবে বেশি টাকার আবেদন এলে অনেক সময় তড়িঘড়ি কিছু করা সম্ভব হয় না।” স্কুলের জন্য টাকা চেয়ে উত্তমবাবু যাঁর কাছে গিয়েছিলেন, মেদিনীপুরের সেই প্রাক্তন সিপিআই সাংসদ প্রবোধ পাণ্ডা আবার বলেন, “ওঁরা যখন এসেছিলেন, তখন অন্য বেশ কিছু স্কুলের জন্য সুপারিশ করে দিয়েছি। ওঁদের তা বলেওছিলাম।”
এই সব না-পাওয়া অবশ্য মনে রাখতে চান না উত্তমবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সচিন স্কুলের জন্য অর্থসাহায্য করেছেন এটাই তো সব থেকে বড় পাওয়া।’’ এই প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বসিত স্কুলের অন্য শিক্ষক এবং অবশ্যই পড়ুয়ারা। একাদশ শ্রেণির পুতুল সিংহ, দ্বাদশ শ্রেণির পায়েল বেরা, দশম শ্রেণির শুভাশিস দোলুইরা বলছিল, “আমাদের স্কুলের সঙ্গে সচিনের নাম জুড়ে গেল, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।” আর সেই আশির দশক থেকে এই স্কুলে শিক্ষকতা করা অজয়কুমার দে, অসিতকুমার বেরার মন্তব্য, ‘‘সচিনের সাহায্য পাওয়াটা যেন রূপকথার মতো।’’
রূপকথা যিনি সত্যি করেছেন, সেই উত্তমবাবুর এখন একটাই ইচ্ছে— সচিনের মুখোমুখি হওয়া।
সচিনের সঙ্গে কথা হয়েছে?
হালকা হেসে উত্তমবাবুর জবাব, ‘‘না, ওটাই শুধু বাকি আছে। তবে ওঁর ব্যক্তিগত সচিব স্কুলের ল্যান্ডফোনে দু’বার ফোন করেছেন। কাজ কেমন চলছে জানতে চেয়েছেন।’’
স্কুলের নতুন ভবনের উদ্বোধনে সচিনকে ডাকবেন তো? প্রশ্ন শুনে আবেগবিহ্বল হয়ে পড়লেন গাঁয়ের মাস্টারমশাই। স্কুলের আলমারি থেকে বের করলেন সচিনের সই করা চিঠি। তার পর বললেন, “উনি তো খুব ব্যস্ত। জানি না পারবেন কিনা। ওঁর ব্যক্তিগত সচিবকে বলেছি। সচিব বলেছেন, সচিন চান তিনি না এলেও স্কুলবাড়ি যেন তৈরি হয়ে পড়ে না-থাকে।’’
দানধ্যান বা ব্যক্তিগত সাহায্যের ব্যাপারে আসলে চিরকালই প্রচারবিমুখ থেকেছেন সচিন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তিনি বিলেতে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকেই আনন্দবাজারের মাধ্যমে তিনি স্কুলটির জন্য তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
ক্রিকেট-পাগল মাস্টারমশাইও জোরকদমে স্কুলের কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন। সেই সঙ্গে বুঁদ স্বপ্নেও, সচিন একদিন না একদিন নিশ্চয়ই আসবেন!