আনন্দবাজারের অন্তর্তদন্ত

এক পয়সা গ্যারান্টি ছাড়াই রেলের এজেন্ট

সিকিওরিটি ডিপোজিট বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি একটি পয়সাও লাগেনি! সারদার ভ্রমণ সংস্থা কোনও রকম আর্থিক জামানত ছাড়াই রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন (আইআরসিটিসি)-এর এজেন্ট হয়ে বসেছিল বলে তদন্তে জানতে পেরেছে সিবিআই। তদন্তকারীদের দাবি, সংস্থার ব্যালান্স শিটে গ্যারান্টি বাবদ খরচের কোনও উল্লেখই নেই! এবং কী ভাবে সেটা সম্ভব হল, তার হদিস পেতে তদন্তকারীরা এ বার সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে জেরা করার কথা ভাবছেন।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৪২
Share:

সিকিওরিটি ডিপোজিট বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি একটি পয়সাও লাগেনি! সারদার ভ্রমণ সংস্থা কোনও রকম আর্থিক জামানত ছাড়াই রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন (আইআরসিটিসি)-এর এজেন্ট হয়ে বসেছিল বলে তদন্তে জানতে পেরেছে সিবিআই। তদন্তকারীদের দাবি, সংস্থার ব্যালান্স শিটে গ্যারান্টি বাবদ খরচের কোনও উল্লেখই নেই!

Advertisement

এবং কী ভাবে সেটা সম্ভব হল, তার হদিস পেতে তদন্তকারীরা এ বার সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে জেরা করার কথা ভাবছেন। এ ব্যাপারে কুণাল ঘোষকেও তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করতে আগ্রহী। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আইআরসিটিসি-র তদানীন্তন কিছু কর্তার মুখোমুখি বসার পরিকল্পনাও সিবিআইয়ের রয়েছে।

ব্যবসায়িক সংস্থার এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করতে গেলে প্রাথমিক বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণস্বরূপ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জামানত (সিকিওরিটি ডিপজিট বা ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি) রাখতে হয়। সারদার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখে সিবিআই বিস্মিত। ব্যুরো সূত্রের খবর: সারদার ওই ভ্রমণ সংস্থা অর্থাৎ ‘সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর পত্তন হয়েছিল ২০০৭-এ। আইআরসিটিসি-র সঙ্গে চুক্তির তিন বছর আগে। অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ’০৯ পর্যন্ত তারা প্রায় ৬১ লক্ষ টাকা লোকসান করে। “পরিষেবা দেওয়ার জন্য এমন এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আইআরসিটিসি’র মতো সংস্থা কী ভাবে চুক্তিবদ্ধ হল? তা-ও কোনও গ্যারান্টি-মানি ছাড়া,” প্রশ্ন তদন্তকারীদের।

Advertisement

এই ধন্দ কাটাতেই সুদীপ্ত-কুণালের পাশাপাশি আইআরসিটিসি’র কিছু অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদের ভাবনা। ২০১০-এ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন আইআরসিটিসি’র সঙ্গে সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের ওই বিতর্কিত চুক্তি সই হয়। জামানত না-নিয়েই লোকসানে চলা সংস্থাকে এ ভাবে এজেন্টের দায়িত্ব অর্পণের পিছনে কোনও ‘প্রভাব’ কাজ করেছিল কি না, সিবিআই সেটাও যাচাই করতে চাইছে। সিবিআই জেনেছে, আইআরসিটিসি’র এজেন্সি লাভের পরেই সারদার ভ্রমণ সংস্থা বিপুল মুনাফার মুখ দেখতে শুরু করে। অডিট রিপোর্ট বলছে, ২০১০-২০১১ অর্থবর্ষে তাদের লাভ হয়েছিল ১৩ লক্ষ টাকা। ২০১১-২০১২ অর্থবর্ষে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষে!

লোকসানে চলা সংস্থা দু’বছরের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মুনাফা করল কী ভাবে, এই প্রশ্নটিও তদন্তকারীদের ভাবাচ্ছে। অডিটরদের সঙ্গে কথা বলে সিবিআইয়ের প্রাথমিক অনুমান, নিছক আইআরসিটিসি-র কমিশন পেয়ে আর ট্রেনের টিকিট বেচে এত লাভ হয়নি। ব্যুরোর সন্দেহ, আইআরসিটিসি-র সঙ্গে চুক্তির অন্যায় ফায়দা তুলেছিল সারদা। রেলের নাম, লোগোর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে টাকা তুলেছিল। এক গোয়েন্দা-কর্তার মতে, আইআরসিটিসি-র সঙ্গে তাঁর ভ্রমণ সংস্থার চুক্তির সুবাদে সুদীপ্ত সেন বিপুল আমানত সংগ্রহের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন।

সারদার ভ্রমণ সংস্থাটির অডিট রিপোর্ট ও ব্যালান্স শিটেও বেশ কিছু গরমিল ধরা পড়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি। চিটফান্ড নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ-আবেদনকারী অমিতাভ মজুমদারও একমত। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অমিতাভবাবুর কথায়, “ব্যালান্স শিটগুলো দেখেছি। অনেক কিছুতে গরমিল। স্বচ্ছতারও অভাব।”

উদাহরণ দিয়ে সিবিআই-সূত্রের বক্তব্য: আইআরসিটিসি-চুক্তি মোতাবেক, ‘ভারততীর্থ’ প্রকল্প থেকে আয়ের ৫% সারদা ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলসের ঘরে যেত, কমিশন বাবদ। চুক্তি-পরবর্তী দেড় বছরে তারা তিনটি ভ্রমণ প্যাকেজের এজেন্ট হয়ে কাজ করেছে, ফলে কমিশনও পেয়েছে। অথচ সংস্থার আয়-ব্যয়ের খাতায় কোথাও রেলের সঙ্গে লেনদেনের উল্লেখ নেই! “এটাই তো মস্ত গরমিল!” মন্তব্য এক তদন্তকারীর।

সিবিআই-সূত্রের খবর: ২০০৭-এর ৩ জানুয়ারি সাকুল্যে লক্ষ টাকা শেয়ার মূলধন নিয়ে ‘সারদা ট্যুর্স অ্যান্ড ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর জন্ম। সংস্থার নথি তা-ই বলছে। উল্লেখ্য, কোম্পানি শুরু করার সময়ে শেয়ার হোল্ডারেরা মোট যত টাকা বিনিয়োগ করেন, সেটাই তার শেয়ার মূলধন বা শেয়ার ক্যাপিটাল। সারদার ভ্রমণ সংস্থাটির শেয়ার হোল্ডার ছিলেন সুদীপ্ত সেন, তাঁর স্ত্রী প্রিয়ঙ্কা ও ছেলে শুভজিৎ। সুদীপ্তের নামে ৫ হাজার, শুভজিতের নামে ৩ হাজার ও প্রিয়াঙ্কার নামে ২ হাজার ইক্যুইটি শেয়ার ছিল, যার প্রতিটির মূল্য ১০ টাকা। সব মিলিয়ে ১ লাখের শেয়ার ক্যাপিটাল।

আর এখানেও তদন্তকারীদের খটকা লাগছে। ওঁদের যুক্তি: আইআরসিটিসি-র মতো বড় নিগমের এজেন্ট হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে গেলে ন্যূনতম শেয়ার ক্যাপিটাল কত হতে হবে, তা কোথাও বেঁধে দেওয়া হয়নি ঠিকই। তবু মাত্র ১ লক্ষ টাকা শেয়ার ক্যাপিটালের (এবং লোকসানে চলা) কোনও সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাটা খুব স্বাভাবিক নয়। এ ক্ষেত্রে উঁচু মহলের সুপারিশ থাকার সম্ভাবনা সিবিআই উড়িয়ে দিচ্ছে না। উপরন্তু ১ লক্ষ টাকা শেয়ার ক্যাপিটাল নিয়ে যাত্রা শুরু করে পাঁচ বছরের মধ্যে সারদা ট্যুরসের সম্পত্তির বহর ৩৪ কোটি ছুঁয়ে ফেলে! যার পিছনে রেলের নাম ভাঙিয়ে আমানতকারীদের থেকে বিপুল টাকা সংগ্রহের ভূমিকা থাকতে পারে বলে সিবিআইয়ের সন্দেহ।

“এই সব কারণেই জানা জরুরি, চুক্তির পিছনে বিশেষ কোনও মহল প্রভাব খাটিয়েছিল কিনা।” বলছেন সিবিআইয়ের এক অফিসার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন