তফসিলি-সংখ্যালঘু স্কুলছুট বেড়ে চলায় উদ্বেগ

মিড-ডে মিল আছে। আছে নিখরচার স্কুল-পোশাক, জুতো। সর্বোপরি প্রাথমিক স্তরে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ। তা সত্ত্বেও রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে তফসিলি ও সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের হার বাড়ছে।

Advertisement

মধুমিতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
Share:

মিড-ডে মিল আছে। আছে নিখরচার স্কুল-পোশাক, জুতো। সর্বোপরি প্রাথমিক স্তরে সম্পূর্ণ বিনা বেতনে পড়াশোনা করার সুযোগ। তা সত্ত্বেও রাজ্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে তফসিলি ও সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের হার বাড়ছে। এমনই বলছে সর্বশিক্ষা মিশনের সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট।

Advertisement

সকলের জন্য শিক্ষার প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের জোরদার প্রচারের মধ্যে এই ম্লান ছবি শিক্ষাজগতের অনেকেরই উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। তবে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই রিপোর্ট মানতে চাইছেন না। প্রকৃত ছবিটা কী, তা জানতে তিনি সমীক্ষা করতে বলছেন নিজের দফতরকেই।

তফসিলি জাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা সম্পর্কে সর্বশিক্ষা মিশনের পর্যবেক্ষণ ঠিক কেমন?

Advertisement

সম্প্রতি ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছরের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সর্বশিক্ষা মিশন। ২০১৪-’১৫ শিক্ষাবর্ষের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্তরে তফসিলি জাতির পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুট ১.৯৬ শতাংশ। ২০১৫-’১৬ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে হয়েছে ৩.৪১ শতাংশ। ২০১৪-’১৫ সালে সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে ১.১১ শতাংশ পড়ুয়া স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। পরের বছরে সেই হার বেড়ে হয়েছে ২.২৬ শতাংশ। আর উচ্চ প্রাথমিকে তফসিলি জাতির পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের হার ৩.৮৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫.০৬ শতাংশ। ওই স্তরে ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরে সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার হার ছিল ৪.৩৭ শতাংশ। ২০১৫-’১৬ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৭০ শতাংশে।

বিনা বেতনে পড়াশোনা, জামা-জুতো-খাবার ছাড়াও অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য রাজ্য সরকার আরও কিছু সুযোগ-সুবিধে ঘোষণা করেছে। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির তফসিলি জাতি, ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত পড়ুয়াদের জন্য রয়েছে ‘শিক্ষাশ্রী’ বৃত্তি। সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের জন্য আছে ‘সংখ্যালঘু বৃত্তি’। তবু পড়ুয়ারা স্কুল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এই প্রবণতা কমার বদলে বেড়ে চলায় শিক্ষাবিদেরা উদ্বিগ্ন।

হরেক সুযোগ-সুবিধে সত্ত্বেও অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা বৃদ্ধির মূলে কোন কোন কারণ দেখছে শিক্ষাজগৎ?

শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের বক্তব্য, ওই সব পরিবারে অনেক ক্ষেত্রে শিশুকে খাটতে পাঠিয়ে দিন গুজরানের সম্বল জোগাড় করা হয়। শিশুরা সারা দিন স্কুলে থাকলে সেই রোজগারটা হয় না। রুটিরুজির এই ঘাটতিতে অনেক পরিবার সমস্যায় পড়ে। তাই শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাড়িয়ে রোজগারের জন্য সন্তানকে কোনও না-কোনও কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা অস্তিত্ব রক্ষার একেবারে মূলগত প্রশ্ন। এ ছাড়া স্কুলছুট বেড়ে চলার আর কোনও কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষাবিদ।

এবিটিএ-র সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য মনে করেন, পড়ুয়াদের উৎসাহ জোগানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারিবারিক অবস্থার বদলটাও জরুরি। ‘‘ওই সব পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো দরকার। আয়ের সংস্থান না-থাকলে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহ তাঁরা দেখাবেন না,’’ বলছেন কৃষ্ণপ্রসন্নবাবু।

একই সুর শোনা গিয়েছে বঙ্গীয় স্কুলশিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী সমিতির সহ-সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডলের বক্তব্যে। তিনি জানান, পড়ুয়াদের পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধে দিলেই তারা স্কুলে আসবে বলে সরকারের বদ্ধমূল ধারণা। কিন্তু ওই সব ছাত্রছাত্রীর পরিবারের আদত সমস্যাগুলির সুরাহা না-হলে অভিভাবকেরা তাদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহ দেখাবেন না।

শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু অবশ্য আগে নিজেরা সমীক্ষা চালিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করতেই বেশি আগ্রহী। কেননা, সর্বশিক্ষা মিশনের রিপোর্টের যাথার্থ্য নিয়েই তিনি রীতিমতো সন্দিহান। তফসিলি এবং সংখ্যালঘু পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের সংখ্যা বাড়ছে, এটা মানতে রাজি নন তিনি। পার্থবাবু জানান, ইতিমধ্যেই তাঁর দফতরের আধিকারিকদের নতুন করে সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘‘সর্বশিক্ষা মিশনের ওই রিপোর্ট নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের বলেছি, জেলায় জেলায় গিয়ে আসল চিত্রটা কী, সেটা তুলে আনতে হবে। আমরা তা খতিয়ে দেখব,’’ বলছেন শিক্ষামন্ত্রী।

স্কুল ছাড়ার অঙ্ক

স্তর ২০১৪-’১৫ ২০১৫-’১৬

• প্রাথমিক তফসিলি ১.৯৬ ৩.৪১

• প্রাথমিক সংখ্যালঘু ১. ১১ ২.২৬

• উচ্চ প্রাথমিক তফসিলি ৩.৮৬ ৫.০৬

• উচ্চ প্রাথমিক সংখ্যালঘু ৪.৩৭ ৫.৭০

*শতাংশের হিসেব। সুত্র: পশ্চিমবঙ্গ সর্বশিক্ষা মিশনের রিপোর্ট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন