শীত নেই, কপাল পুড়ল নলেনের

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে রূপের রসে মজে ফলাও গুড়ের ব্যবসা লাটে তুলেছিল মোতালেফ। এ মরসুমে পশ্চিমবঙ্গের তামাম নলেন গুড় ব্যাপারীর মাথায় বাড়ি মেরেছে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। শীতকালে শীত নেই। তাই খেজুরগাছে রসই অমিল।

Advertisement

দেবাশিস দাস

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৪:২০
Share:

রস নেই। তাই গুড়ও নেই।

Advertisement

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পে রূপের রসে মজে ফলাও গুড়ের ব্যবসা লাটে তুলেছিল মোতালেফ। এ মরসুমে পশ্চিমবঙ্গের তামাম নলেন গুড় ব্যাপারীর মাথায় বাড়ি মেরেছে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। শীতকালে শীত নেই। তাই খেজুরগাছে রসই অমিল।

পরিণামে সুস্বাদু, সুগন্ধি নলেন গুড় দুর্লভ থেকে দুর্লভতর হয়ে উঠেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের শিক্ষক উৎপল রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘প্রতিকূল আবহাওয়ায় খেজুর গাছে রস নিসঃরণের পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছে। রস হয়ে গিয়েছে বিস্তর পাতলা। গন্ধেও ফারাক।’’ বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মানুষের ঘামের মতো খেজুর গাছের রসও বর্জ্য। উপাদান— শর্করা, অল্প প্রোটিন ও একাধিক সুগন্ধি রাসায়নিক যৌগ।

Advertisement

আর তারই কদর দুনিয়া জুড়ে। শীতের খেজুর রস থেকে তৈরি বাংলার নলেন গুড়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বাঙালি গেরস্তবাড়িতে দুধ-মুড়ি-চিঁড়ে-খই-রুটিতে নলেন গুড় মেখে জলযোগের রেওয়াজ চিরকালীন। পৌষ পার্বনে খেজুর গুড়ের পিঠে-পায়েস। শীতকাল মানে মিষ্টির দোকানে নলেন গুড়ের বিবিধ মিষ্টির পসরা। সঙ্গে ওতপ্রোত জয়নগরের মোয়া। কনকচূড় ধানের সুগন্ধি খই, ক্ষীর ও নতুন গুড় দিয়ে বানানো সেই মোয়ার দৌলতে বিদেশেও ছড়িয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের নাম। এখন তো নলেন গুড়ের আইসক্রিম পর্যন্ত মজুত! অভিজাত ক্লাবে বা কিংবা পাঁচতারায় ডেজার্ট-মেনুতে তার সগৌরব উপস্থিতি।

অথচ বছর পাঁচেক ধরে বাংলার নলেনের স্বাদ ক্রমশ ম্লান। সুগন্ধও যেন ফিকে। নেপথ্যে আবহাওয়ার কারিকুরি। এ বছরে ব্যাপারটা আরও বেশি মালুম হচ্ছে। খেজুর রস মূলত পাওয়া যায় দক্ষিণবঙ্গে। বিশেষত দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, নদিয়া, বাঁকুড়ায়। এবং দক্ষিণবঙ্গেই এ বার শীতের রথ পদে পদে হোঁচট খেয়ে গুড়ের কপালে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কী রকম?

উৎপলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘উৎকৃষ্ট মানের খেজুর রস পেতে হলে শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকতে হবে টানা বেশ ক’দিন।’’ সে জায়গায় এ বার দক্ষিণবঙ্গে ১০ তো দূরের কথা, ১২ ডিগ্রি মিলেছে সাকুল্যে দু’-তিন দিন। জেলায় জেলায় শৈত্যপ্রবাহ বয়েছে মাত্র দিন তিনেক। জয়নগরের বিধায়ক তরুণকান্তি নস্করের আক্ষেপ, ‘‘গত মরসুমে দু’সপ্তাহের মতো শীত পড়েছিল। এ বার তো এক সপ্তাহও ঠিকঠাক শীতের দেখা মিলল না!’’

তাই ভাল মানের রসও মেলেনি। জয়নগরের মোয়া, গুড়, পাটালি,
খই উৎপাদন শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক সুবীর দাস জানাচ্ছেন, ঠিক মতো শীত পড়লে একটা খেজুর গাছের ‘ডাবরি’ (রস ধরার কলসি) থেকে গোটা মরসুমে চার কেজি রস পাওয়া যায়। এ বার মিলেছে তিন কেজির কম। তা-ও সর্বোচ্চ মানের নয়। ‘‘জিরেন কাটের রস প্রায় আসেইনি।’’— বলছেন সুবীরবাবু। সেটা কী?

ওঁদের ব্যাখ্যা: প্রবল শীতে টানা দু’-তিন দিন কাটা-চাঁছার পরে গাছটিকে তিন দিন বিশ্রাম (বা জিরেন) দিয়ে ফের কাটা হয়। তখন পাওয়া রস-ই হল জিরেন কাটের রস। তা দিয়েই হয় এক নম্বর গুড়। ভাল জয়নগরের মোয়ার আবশ্যিক উপাদান জিরেন কাটের গুড়। শীত যত ভাল পড়বে, জিরেনের মানও বাড়বে।

কিন্তু এ বার শীতই উধাও। কাজেই উৎকৃষ্ট জিরেন রসে টান। রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন দফতরও কার্যত হাত তুলে দিচ্ছে। ‘‘শীত না পড়লে তো কিছু করার নেই!’’— মন্তব্য
কর্তাদের। মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী অবশ্য বলেন, ‘‘একটা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের সাহায্যে নানা এলাকায় নতুন খেজুর
গাছ পোঁতার পরিকল্পনা নিয়েছি।’’

এই পরিকল্পনা সফল হলে খেজুর রস ও গুড়ের পরিমাণ বাড়বে ঠিকই। কিন্তু তার সেই গুণ, মান, স্বাদ বা গন্ধ ফিরে আসবে কি না, তা ঠিক করে দেবে প্রকৃতিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন