কালীঘাটে ধমক খেয়ে, বনগাঁয় ফিরে চা

শোনা যাচ্ছে, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বকুনি এতটাই কাজে এসেছে, একই গাড়িতে চেপে কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনগাঁ ফিরেছেন বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য। দু’জনে খোসগল্পও করেছেন। শঙ্করবাবু নিজের সঙ্গে থাকা রুটি-তরকারির টিফিন বাক্স এগিয়ে দিলে রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরেছেন বিশ্বজিৎবাবু। পরে বনগাঁ শহরের বাটার মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে দু’জনকে এক সঙ্গে চা খেতেও দেখা গিয়েছে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৪৯
Share:

বরফ কি গলবে বিশ্বজিৎ দাস (বাঁ দিকে) ও শঙ্কর আঢ্যের মধ্যে?

প্রথমে দলনেত্রীর ধমক, পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক সঙ্গে চা খেলেন দুই তৃণমূল নেতা।

Advertisement

শোনা যাচ্ছে, দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বকুনি এতটাই কাজে এসেছে, একই গাড়িতে চেপে কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনগাঁ ফিরেছেন বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য। দু’জনে খোসগল্পও করেছেন। শঙ্করবাবু নিজের সঙ্গে থাকা রুটি-তরকারির টিফিন বাক্স এগিয়ে দিলে রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরেছেন বিশ্বজিৎবাবু। পরে বনগাঁ শহরের বাটার মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে দু’জনকে এক সঙ্গে চা খেতেও দেখা গিয়েছে।

যা নিয়ে বনগাঁর মানুষের মধ্যে কৌতুহল কম নয়। রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে চলছে সেই আলোচনা। তবে বনগাঁবাসী এমনিতে দুই নেতার দ্বৈরথ নিয়ে এত দিন ওয়াকিবহাল ছিলেন না। দু’পক্ষের অনুগামীদের মধ্যে প্রকাশ্যে কোনও গোলমাল কখনও কেউ দেখেননি। সকলের সামনে কখনও তকার্কিতেও জড়িয়ে পড়েননি শঙ্করবাবু ও বিশ্বজিৎবাবু। তবে দু’জনের ঘনিষ্ঠ মহল বা তৃণমূলের সক্রিয় কর্মীরা বা পুরসভার দলীয় কাউন্সিলর সকলেই জানেন, দু’জনের সম্পর্ক ক্রমেই তলানিতে পৌঁছেছে। এমনিতে বনগাঁ পুরসভাই হোক বা লোকসভা, বনগাঁয় তৃণমূলের রাজনৈতিক ক্ষমতা বহু বছর ধরেই প্রশ্নাতীত। তারপরেও দলনেত্রীকে কেন এত কড়া বার্তা দিতে হল, তা ভাবাচ্ছে সব পক্ষকেই।

Advertisement

চায়ের দোকান থেকে উড়ে এল মন্তব্য, ‘‘হুঁ হুঁ বাওয়া, দিদির কাছে সব খবরই থাকে। পাহাড় থেকে সাগর— কোথায় কী হচ্ছে, কোন নেতার সঙ্গে কার দহরমমহরম, কার মুখ দেখাদেখি বন্ধ— সব দিকে ওঁর নজর।’’ নেত্রীর উদ্যোগকে সাধারণ কর্মীরা সাধুবাদই দিয়েছেন। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা পড়েছি মহা সমস্যায়। অন্য পক্ষের কারও সঙ্গে প্রকাশ্যে মন খুলে কথা পর্যন্ত বলতে পারি না। নেতারা নিজেরা প্রকাশ্যে ভাল সম্পর্ক রাখবেন, অথচ আমাদের তা রাখতে গেলেই বিপদ। নেত্রীর উচিত বনগাঁ শহরের দিকে কড়া নজর রাখা।’’

পুরপ্রধান ও বিধায়কের মধ্যে সম্পর্কের চোরাস্রোত অবশ্য দলের জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সরাসরি মানতে চাননি। যদিও তাঁর বক্তব্য, ‘‘তৃতীয় একটা পক্ষ ওদের মধ্যে বিরোধ বাধানোর চেষ্টা করছে। আমরা শীঘ্রই তাদের শনাক্ত করছি। ওই বিষয়ে বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি নিজেও শীঘ্রই বনগাঁয় গিয়ে ফের দু’জনকে নিয়ে বসব।’’

‘বসা’র যে দরকার আছে, তা এ ভাবেই মেনে নিচ্ছেন জ্যোতিপ্রিয়। যেমন দলনেত্রীর নির্দেশে সেপ্টেম্বর মাসে দু’পক্ষকে নিয়ে আগেও বসতে হয়েছিল তাঁকে। সে সময়ে দু’পক্ষের মধ্যে বরফ গলে জ্যোতিপ্রিয়বাবুর মধ্যস্থতাতেই।

বনগাঁ শহর যুব তৃণমূল সভাপতি প্রসেনজিৎ ঘোষ আবার সরাসরি গোষ্ঠীকোন্দলের প্রসঙ্গ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘প্রকাশ্যে অন্তত কোনও বিরোধ দেখিনি। যদি ভিতরে ভিতরে থেকেও থাকে, তা হলে বিধানসভা ভোটের আগে ওঁদের তা মিটিয়ে নেওয়া উচিত।’’

শনিবার কালীঘাটে দলের উত্তর ২৪ পরগনার নেতা, জন প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন মমতা। সেখানেই বনগাঁ বিশ্বজিৎবাবু ও শঙ্করবাবুকে নাম ধরে ডেকে দাঁড় করিয়ে ‘শেষ ওয়ার্নিং’ দেন দলনেত্রী। নিজেদের মধ্যে যেন বিরোধ না রেখে উন্নয়নের কাজে মন দেন দুই নেতা, সে কথা কড়া ভাষায় জানিয়ে দেন। সম্প্রতি জেলা ধরে ধরে নেতাদের নিয়ে এই কাজটাই করছেন মমতা। বিধানসভা ভোটের আগে দলের অন্দরের কোন্দল মেটানোর রাজনৈতিক দায় আছে তাঁর। শঙ্করবাবু ও বিশ্বজিৎবাবুকে সতর্ক করা, তারই ইঙ্গিত বলে জানাচ্ছে দলের একটি সূত্র। তবে ওই দুই নেতা ছাড়াও মমতার সঙ্গে বৈঠকে দলের আরও বেশ কিছু নেতা, জনপ্রতিনিধি ধমক খেয়েছেন বলে দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে।

কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অতীতে শঙ্করবাবুর দলের শহরের সভাপতি হওয়া, পুরসভা ভোটে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা বা শহরের কোন ক্লাব সরকারি টাকা পাবে— মূলত এ সব নিয়েই দু’জনের মধ্যে চাপানউতোর রয়েছে। শহরের তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘বিবাদ যতটা না রাজনৈতিক, তার থেকে বেশি ব্যক্তিগত।’’

শঙ্করবাবু যদিও বলেন, ‘‘বিধায়কের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত কোনও বিরোধ নেই। ওর সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ নিজেদের স্বার্থেই আমাদের মধ্যে বিরোধ বাধানোর চেষ্টা করছেন। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’’ বিশ্বজিৎবাবুও জানিয়েছেন, ‘‘পুরপ্রধানের সঙ্গে আমার কোনও রাজনৈতিক বিরোধ নেই। আমি সকলকে নিয়েই চলি। রাজনৈতিক ভাবে কিছু দেউলিয়া মানুষ আমাদের সম্পর্কে অপ্রচার করার চেষ্টা করছে।’’

কিন্তু জ্যোতিপ্রিয়বাবু যাকে ‘তৃতীয় পক্ষ’ বলছেন, শঙ্করবাবু যাঁদের ‘স্বার্থান্বেষী’ বলছেন কিংবা বিশ্বজিৎবাবুর কথায় যাঁরা ‘রাজনৈতিক ভাবে দেউলিয়া’— তারা কারা? এ নিয়ে মুখে তালা সব পক্ষের। তবে দলের অন্য একটি সূত্র জানাচ্ছে, বনগাঁয় সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে কিছু কর্মী ইদানীং নানা ভাবে দুই নেতার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চাইছে।

কিন্তু নেত্রী কী তা হলে ভুল তথ্যের ভিত্তিতেই বললেন এত কথা? প্রশ্ন শুনে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেও বিশ্বজিৎবাবু, শঙ্করবাবুরা আবারও দাবি করেছেন, ‘‘ধমক খেলাম কোথায়? উনি তো মিলেমিশে উন্নয়ন করার কথাই বললেন খালি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন