মৃত্যুসংবাদ জানা গেল আবেদনপত্রে

একই গ্রামে ৭ শবরের মৃত্যু লালগড়ে, জানলই না প্রশাসন!

ঘটনাস্থল ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় ব্লকের পূর্ণাপাণি গ্রাম সংসদের জঙ্গলখাস গ্রাম। জেলা সদর থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ২৪ কিলোমিটার। অথচ মৃতের পরিজনেরা সোমবার লিখিত ভাবে লালগড়ের বিডিওর কাছে জানানোর আগে পর্যন্ত এক জনেরও মৃত্যু খবর প্রশাসনের কাছে আসেনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

লালগড় শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:২৫
Share:

অসহায়: তিন কন্যাকে নিয়ে মৃত পল্টু শবরের স্ত্রী ময়না। নিজস্ব চিত্র

উৎসবের রেশ কাটিয়ে সরকারি অফিস চালু হতেই সামনে এল মৃত্যুসংবাদ। এক-দু’জন নয়। গত ১৫ দিনে একই গ্রামের শবর সম্প্রদায়ের সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা।

Advertisement

ঘটনাস্থল ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় ব্লকের পূর্ণাপাণি গ্রাম সংসদের জঙ্গলখাস গ্রাম। জেলা সদর থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ২৪ কিলোমিটার। অথচ মৃতের পরিজনেরা সোমবার লিখিত ভাবে লালগড়ের বিডিওর কাছে জানানোর আগে পর্যন্ত এক জনেরও মৃত্যু খবর প্রশাসনের কাছে আসেনি। মৃতের পরিজনেরা লিখেছেন, ‘গত কয়েক দিনে আমাদের পরিবারগুলির সাত জন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান’। আর্থিক সাহায্যও চেয়েছেন তাঁরা। ভবিষ্যতে আর যেন কারও মৃত্যু না হয়, প্রশাসনের কাছে সেই আবেদনও জানানো হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, মৃত মঙ্গল শবর (২৮), কিসান শবর (৩৪), লেবু শবর (৪৬), সুধীর শবর (৬৩), সাবিত্রী শবর (৫১), পল্টু শবর (৩৩) ও লাল্টু শবরের (৩৮) প্রত্যেকেই কম-বেশি অসুস্থ ছিলেন। কয়েক জনের যক্ষ্মার চিকিত্সা হচ্ছিল। সকলেরই মৃত্যু হয়েছে বাড়িতে। কয়েক জন নিকটবর্তী তাড়কি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওষুধ পেতেন। কিন্তু অভিযোগ, নিয়মিত ওষুধ খেতেন কি না, সে ব্যাপারে তেমন নজরদারি ছিল না।

Advertisement

ঝাড়গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে লোধা-শবরদের বাস। আদিবাসী জনজাতির এই মানুষদের অধিকাংশেরই এক চিলতে চাষজমিও নেই। অন্যের জমিতে মজুর খেটে কিংবা জঙ্গল থেকে কাঠ-পাতা কুড়িয়ে দিন গুজরান হয়। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর চল খুব একটা নেই। অল্পবয়সে বিয়ে, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নেশা করা আর পরিবার-পরিজন সম্পর্কে উদাসীনতা এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গিতে মৃত্যু মায়ের, অসুস্থ সদ্যোজাত পুত্র

এ দিকে জনজাতিদের অনুন্নয়নের সুযোগ নিয়ে একদা মাওবাদীদের খাসতালুকে পরিণত হয়েছিল জঙ্গলমহল। এখন অবশ্য বসতবাড়ি থেকে চাষজমি, বিশেষ রেশন, বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ, নিখরচায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা— সব প্রকল্পই রয়েছে লোধা-শবরদের জন্য। তবে অভিযোগ, সরকারি প্রকল্পে পাওয়া জিনিসপত্র বেচে দেন তাঁরা। বাড়ির দরজা-জানলা, ইট, ছাদের অ্যাসবেস্টসও খুলে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁদের একাংশের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন: বিয়ে বন্ধ করতে মুচলেকা সার?

ফলে শুধু সরকারি সাহায্য নয়, লোধা-শবরদের প্রতি প্রশাসনিক নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু ৭ জন শবরের মৃত্যুর খবর অজানা থাকাটা তো প্রশাসনিক উদাসীনতার দিকেই ইঙ্গিত করছে। ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আয়েষা রানি বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সদস্যের ঘটনাটি ব্লক প্রশাসনকে জানানো উচিত ছিল। কেন জানানো হল না, খতিয়ে দেখা হবে। রাতেই বিডিও পূর্ণাপানি গিয়েছেন। মঙ্গলবার স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ দল গ্রামে যাবে। আমিও যাব।’’

ব্লক প্রশাসনের তরফে মৃতের পরিজনদের কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে এ দিনই। গ্রামে গিয়েছিলেন বিএমওএইচ মহেশ্বর মান্ডি। ঝাড়গ্রামের মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক অশ্বিনীকুমার মাঝি বলেন, “আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। মদ্যপানজনিত কারণে মৃত্যু কি না, দেখা হচ্ছে।’’

দ্রুত মৃত্যুসংবাদ পৌঁছয়নি রাজনৈতিক স্তরেও। তৃণমূলের কয়েকজন কর্মীর থেকে বিষয়টি জেনে লালগড় পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বিজল সাহা সোমবার তৎপর হন। তাঁর উদ্যোগেই ব্লক অফিসে আবেদন জমা পড়ে। পূর্ণাপাণির পঞ্চায়েত সদস্য তৃণমূলের বাসন্তী সিংহ বলেন, “শুনেছি কয়েক জন শবর অসুস্থ ছিল। কয়েক জনের বয়স হয়ে গিয়েছিল।” প্রশাসনকে জানাননি কেন? আমতা আমতা করে বাসন্তী ফোন ধরালেন স্বামী বিনোদ সিংহকে। বিনোদের দাবি, ‘‘কয়েক জনকে লালগড় হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। একটু সুস্থ হতেই ওরা বাড়ি চলে আসে।”

অনেকেরই বাড়ির একমাত্র উপাজর্নকারীর মৃত্যু হয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে পরিবার। মৃত লেবু শবরের স্ত্রী বিজলা শবর, মৃত সুধীর শবরের ছেলে খ্যাপা শবর বলেন, “সাহায্য না-পেলে বাঁচা দায়।” মেদিনীপুর লোধা-শবর কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বলাইচন্দ্র নায়েকের অভিযোগ, ‘‘শবর পল্লিগুলিতে প্রশাসনের নজরদারি না থাকা়তেই এমন ঘটনা ঘটছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন