রাজ্যের মহিলাদের আর্থিক সহায়তার জন্য ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
কপালে টানা তিলকের শেষটি নেমে এসেছে নাকে, গলায় তুলসী কাঠের মালা, রোগাসোগা মেয়েটি সাইকেল চালিয়ে ঢুকলেন ঋত্বিক সদনে। বাঁ পাশে জড়ো করে রাখা সাইকেলের সারিতে নিজেরটা কোনও মতে হেলিয়ে রেখে চললেন প্রেক্ষাগৃহের দিকে। সেখানে চলছে কল্যাণী পরিচারিকা কল্যাণ সমিতির সম্মেলন। গদি-মোড়া চেয়ারে বসে দুই বান্ধবীর সঙ্গে সবে গল্প শুরু করেছেন, তখনই করা গেল প্রশ্নটা, “এ বারও কি লক্ষ্মীর ভান্ডারেই ভোট দিচ্ছেন?”
সুনীতা, ফুলমণি, পুণ্যলতা (নাম পরিবর্তিত) এ ওর দিকে চেয়ে হেসে ফেললেন। “মমতা দিদি খুব ভাল করেছেন টাকাটা দিয়ে। কত ঘরে মেয়েটা সারাক্ষণ সংসারের কাজ করে, কুড়িটা টাকাও কেউ হাতে দেয় না। বাড়ি থেকে বেরোতেও দেয় না।” কী করে মেয়েরা এই টাকা দিয়ে? হেসে গড়িয়ে পড়লেন ওঁরা। সুনীতা বললেন, “বার বার হাত পাততে হয় না। ছেলেমেয়ে কিছু চাইলে মাদিতে পারে।”
সমিতির সভানেত্রী, বছর চৌত্রিশের ডলি হালদার আর একটু এগিয়ে ভেবেছেন। বললেন, “মেয়েরা ভাবছে, কিছু তো হাতে পাওয়া যাচ্ছে। শোষণের ধারণাটা তাদের মধ্যে কাজ করছে না। সব কিছুতে জিএসটি বসেছে। তেল, ডালের দাম দেখুন। এ দিকে একটা বাড়িতে সারা মাস রান্না করে, বাসন মেজে দু’তিন হাজারটাকা মেলে।”
টাকা হাতে পাওয়ার এই খুশির পাশে গাঢ় হয়ে উঠছে কাজ করে টাকা না-পাওয়ার ক্ষোভ। ফুলিয়ার তাঁতি মেয়েদের গলায় রাগ, “অটো, বাসের ভাড়া, বাজারে খাবারের দাম ডবল হয়েছে। আর শাড়ি বোনার মজুরি হয়েছে অর্ধেক।” সাদামাঠা শাড়ি বুনে আগে পাঁচশো টাকা মিলত, এখন মহাজন দেয় আড়াইশো টাকা। করুণা দাস, কমলা সরকাররা (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, আঁচলের তলায় ঝুলন্ত পমপম (মেয়েরা বলেন, ‘কদম’) চব্বিশটা তৈরির মজুরি পাঁচ টাকা। এক কিলোগ্রাম উলের পমপম বানালে মহাজন দেয় ষাট টাকা। এই কি শ্রমের দাম? মেয়ে তাঁতিদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী সরকারি বরাত পায় না, তাঁতি-সমবায় পায় অতি সামান্য— অধিকাংশ বরাত যায় সরকার-ঘনিষ্ঠ বড় ব্যবসায়ীদের কাছে। “আমরা টাকা চাই না, সরকার জিনিসের দাম কমাক। মহাজনের সঙ্গে কথা বলে মজুরি বাড়াক,” বললেন মেয়েরা।
এ কেবল বাজারের মার নয়, আইনের শাসনের শিথিলতাও। ছ’মাস অন্তর প্রায় আশিটি পেশায় ন্যূনতম মজুরির তালিকা প্রকাশ করে রাজ্য, কিন্তু বাস্তবে কোন পেশায় কত মজুরি মিলছে, শ্রম দফতরের ইনস্পেক্টররা তার খোঁজ রাখেন না। সমাজকর্মী নব দত্ত বলেন, “এ রাজ্যে অন্তত ২৯ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই মহিলা, দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চাইতে গড়ে ১০০ টাকা কম পাচ্ছেন। যার মানে, বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার মজুরি চুরি হয়। একই ছবি চটকলে, চা বাগানে।” এই বিপুল ক্ষতি কিছুতেই নির্বাচনী রাজনীতির বিষয় হয়ে ওঠে না।
হবেই বা কেন? ঠিকাদার-মহাজনই তো নির্বাচনের টাকা জোগায়, তাদের অনেকে শাসক দলের মুখ। কেন তাদের চটাতে চাইবে রাজনৈতিক দল? দিল্লিতে ‘মহিলা সমৃদ্ধি যোজনা’ (মাসে ২৫০০ টাকা) ঘোষণা করে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সরকারকে কুপোকাত করল বিজেপি, মহারাষ্ট্রে ‘লড়কী বহিন’ প্রকল্প (মাসে ১৫০০ টাকা) বিজেপি সরকারকে টিকিয়ে রাখল। ঝাড়খণ্ডে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের শরিক হেমন্ত সরেন আনলেন ‘মাইয়া সম্মান’ প্রকল্প (মাসে ১০০০ টাকা)। বিহারেও ‘ইন্ডিয়া’ শরিকরা মাসে ২৫০০ টাকা অনুদানের ঘোষণা করেছিল, কিন্তু নীতীশ কুমার শেষ বেলায় খেলেছেন তুরুপের তাস — দশ হাজার টাকা করে দিয়েছেন মেয়েদের অ্যাকাউন্টে। “এককালীন এতগুলো টাকা নিঃশর্তে দেওয়াটা কি ঘুষ দেওয়ার খুব কাছাকাছি নয়?” বললেন যোগেন্দ্র যাদব। এ হল নীতির প্রশ্ন। রাজনীতির উত্তর তিনি পেয়েছেন — এ বার ৯ শতাংশ বেশি মহিলা বেরিয়েছেন ভোট দিতে, যা প্রায় অবিশ্বাস্য। যোগেন্দ্র বলেন, “মেয়েদের ভোটের জন্যও যে লড়াই করতে হয়, এই উপলব্ধিটা ভাল। মন্দ দিক হল, এই বিপুল টাকা মেয়েদের ভবিষ্যতের পথ গড়ে না। দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়নের কাজে লাগে না ওই টাকা।”
মেয়েরা কি সে কথা বোঝেন না? কুলতলির এক অঙ্গনওয়াড়ি সহায়িকা বললেন, “যখন লক্ষ্মীর ভান্ডার ঘোষণা হয়েছিল, ভেবেছিলাম — দিদি আমাদের জন্য ভাবছেন। এখন দেখছি, ওটা ছুড়ে দিয়েছে কেবল। আমাদের অভাব-অভিযোগের কথা মন্ত্রী, অফিসাররা কানে তোলেন না।” তাঁতি মেয়েরা আরও ঝাঁঝালো, “আমাদের টাকাই তো আমাদের দিচ্ছে, আবার আমাদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে।” সে দিন তা-ও দেখা গেল কল্যাণীতে। বেলা দুটোয় ছাড়তে হল ঋত্বিক সদন, কিন্তু তখনও সব আইডি কার্ড বিলি শেষ হয়নি। পাশের মাঠে জড়ো হয়েছেন মেয়েরা, হঠাৎ শুরু হল শাসক দলের কর্মীদের হুমকি — কার অনুমতি নিয়ে মাঠে ঢুকেছেন পরিচারিকারা? পুলিশও চলে এল। এক কর্মীকে গ্রেফতার করতে চাইলে ডলি হালদার বলেন, “আমি সভানেত্রী, আগে আমাকে গ্রেফতার করুন।” বাকি মেয়েরাও দাবি তোলেন, ধরতে হলে সকলকে নিয়ে যেতে হবে। শেষে নাম-ঠিকানা লিখে পুলিশ ফিরে গেল।
এমন মেয়েরা, যাঁরা কিছু আশা করেন রাজনীতির কাছে, তাঁদের দাবিকে তুলে ধরছে কে? তেমন বিরোধী দল, দলীয় কর্মী, এ রাজ্যে কোথায়?
(চলবে)
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে