international mother language day

একুশের মৃত্যু এবং ‘বেবি’র পছন্দ

সদ্য স্নান সারা পোর্সেলিনের আমগ্ন শিব ঠাকুরের হাত কয়েক দূরে অতিকায় ডিজে বাক্স ফুঁড়ে ‘বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায়’। শিব-ভক্ত উদোম গা বারমুডা-তরুণ আর কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে উচ্ছ্বল জনা তিনেক তরুণীর নাচ একুশের সকাল বিভোর করে রেখেছে।

Advertisement

রাহুল রায়

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:৪৩
Share:

ছবি: এএফপি

কালো বাক্স থেকে গুবগুব করে হৃদস্পন্দন ছিটকে আসছে। রাস্তার বাঁকে রংচটা মন্দির-চাতালে আলো-মালার শিকলি, জল ছিটানো লম্বা বিনুনির মতো গাঁদার মালা, ফাগুন হাওয়ায় ঘি-ছোঁয়া খিচুড়ির গন্ধ।

Advertisement

সদ্য স্নান সারা পোর্সেলিনের আমগ্ন শিব ঠাকুরের হাত কয়েক দূরে অতিকায় ডিজে বাক্স ফুঁড়ে ‘বেবি কো বেস পসন্দ হ্যায়’। শিব-ভক্ত উদোম গা বারমুডা-তরুণ আর কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে উচ্ছ্বল জনা তিনেক তরুণীর নাচ একুশের সকাল বিভোর করে রেখেছে। বর কিংবা হবু-স্বামীর কল্যাণ এবং প্রাপ্তির বুক চাপা উত্তেজনা নিয়ে জলজ বোতল-ঘটি নিয়ে নানা বয়সী মেয়ে-

মহিলার লাইনটা সেই উন্মত্ত নাচে মোহিত হয়ে ছদ্ম রাগ দেখাচ্ছে, ‘ওহ পারে বটে!’

Advertisement

শিব-রাত্তিরের বারবেলা পিছনে ফেলে শ’দুয়েক গজের মধ্যেই খান কয়েক ইটের উপরে সাদা কাগজ লেপ্টে একটা হাঁটু-উঁচু মঞ্চ গড়েছে পাড়ার ক্লাব। শীর্ণ মঞ্চের উপরে অনাদরের এক মুঠো রজনীগন্ধা আর শুভ্র নয়নতারার আবহে প্রতুলবাবু তাঁর স্বর টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় ...‘আমি বাংলায় গান গাই’—

বাকিটা বেবির পছন্দের হুঙ্কারে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে! বেলা গড়াচ্ছে। শহরের সরু রাস্তার হাত কয়েকের তফাতে ধর্ম এবং সংস্কৃতির নিপাট সহবস্থান।

ছুটির সকালে সেই গান এবং গানের গুঁতোয় খুঁড়িয়ে চলা অটোর কোণ ঘেঁষে বাবার সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে প্রশ্নটা ঝুলিয়ে দেয় আচমকা,
—হোয়াট হ্যাপেনড পাপা!
আজ শিবরাত্রি, জানিস না, তোদের স্কুলে ছুটি দিল যে!
চাকা ঈষৎ গড়াতে বাঁ দিকের নমো নমো মঞ্চের দিকে চোখ পড়তেই ছুট্টে আসে পরের প্রশ্নটা
—অ‌্যান্ড দিস ওয়ান?

সাদা শহিদ বেদির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তাঁর সহজাত জ্ঞানটুকু বিলিয়ে দেন, ‘কেউ মারা গিয়েছে হয়তো, তাই শহিদ বেদি করেছে, তোদের আন্টিকে জিজ্ঞেস করিস বোধহয় মার্টার অল্টার বলে।’
মেয়ে চুপ, বাবা স্তব্ধ। এঁকেবেঁকে হারিয়ে যেতে থাকে অটো। আর শহিদ বেদির আড়ালে নিশ্চুপ লজ্জায় মরে যেতে থাকে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। শব্দহীন গতিতে মরতে থাকে একটা ভাষা আর তাকে আঁকড়ে থাকে সংস্কৃতি।

মেলায় হারানো শিশু মা’য়ের খোঁজ করে যে ভাষায়, খিদে পেলে বায়না জোড়ে যে শব্দে, অযথা উদ্বেগ নিয়ে কাছের মানুষ মানুষের কাছে ঘ্যানঘ্যান করা যে অক্ষরে— সেই আপন ভাষার অনায়াস হাত ধরে বেঁচে থাকার তাগিদে ঢাকার রাজপথে রক্তাক্ত করে ভাষা দিবস এনে দিয়েছিল যারা, একুশের সকালে শহিদ বেদির পরিচয়ে তারা সত্যিই ‘মারা গিয়েছে’। বাকিটা শিব ঠাকুরের আপন দেশে স্বপ্নভূক বেঁচে থাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন