স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শহরে তল্লাশি পুলিশের। —নিজস্ব চিত্র।
একে সামনে স্বাধীনতা দিবস। তার উপরে ইয়াকুব মেমনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পরে প্রতিশোধের হুমকিও মিলছে। ফলে, অতি মাত্রায় স্পর্শকাতর শিলিগুড়ি করিডরে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ফলে, এখন শিলিগুড়ি লাগোয়া সব কটি সীমান্তে নজরদারি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন ও আধা সামরিকবাহিনী। বিনা পরীক্ষায় মাছি গলবার যো নেই। ভারত-নেপাল সীমান্তে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, অগস্টের গোড়া থেকে স্বাধীনতা দিবসের পরে এক সপ্তাহ পর্যন্ত ‘লাইন’ বন্ধ থাকবে। তবে চোরাগোপ্তা ‘লাইন’ চলছেই বলে দাবি করেছেন শিলিগুড়ির বিদেশি পণ্যের বাজারের ব্যবসায়ীদের একাংশ। শিলিগুড়ির ভারত নেপাল সীমান্তের চোরাচালানের দুনিয়ায় ‘লাইন’ শব্দে অর্থ হল, পুলিশ-প্রশাসন-শুল্ক দফতরের একাংশকে হাত করে পণ্য পাচারের সুবন্দোবস্ত। পুলিশ-প্রশাসন ও শুল্ক দফতরের তরফে যা কি না সব সময়েই ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয়।
কেন্দ্র ও রাজ্য গোয়েোন্দাদের কাছে যে সতর্ক বার্তা পৌঁছেছে তাতে বলা হয়েছে, উত্তর পূর্ব ভারতে সক্রিয় জঙ্গিরা স্বাধীনতা দিবসের কথা মাথায় রেখে নাশকতার ছক কষছে। উপরন্তু, নেপালে জাল বিছিয়ে রাখা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন, লস্কর ই তইবার মতো জঙ্গি দলও শিলিগুড়ি করিডর ব্যবহার করে নাশকতা ঘটাতে সক্রিয় বলে আশঙ্কা করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই শিলিগুড়ি করিডর এলাকায় চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। অন্তত ১০ জন জঙ্গি প্রশিক্ষিত জঙ্গি শিলিগুড়ি করিডর ব্যবহার করে উত্তরবঙ্গে নাশকতা ঘটাতে ঢুকেছে বলেও গোয়েন্দাদের আশঙ্কা। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানান, আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ না রেখে সব ধরনের আশঙ্কা মাথায় রেখেই চরম সতর্কতা জারি হয়েছে।
বস্তুত, একাধিক নাশকতায় যুক্ত থাকার দায়ে ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির সাজা কার্যকর হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বদলে গিয়েছে ভারত-নেপাল সীমান্তের শিলিগুড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কদিন আগে অবধি মুখ চেনা রিকশাচালক কিংবা ছোলা-বাদামের ফেরিওয়ালা অনায়াসে কোনও তল্লাশির মুখে না পড়ে রোজ নেপালে যাতায়াত করতে পারতেন। একন তাঁদেরও রেহাই মিলছে না আধা সামরিক বাহিনীর হাত থেকে। এক সপ্তাহ আগেও সারা শরীরে বিদেশি পণ্য (নানা ধরনের কাপড়, ছাতা, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম) দড়ি দিয়ে বেঁধে মেচি পেরিয়ে নকশালবাড়িতে অনায়াসে ঢুকেছেন বলে বাসিন্দাদের একাংশই জানিয়েছেন।
এখন সেটাও প্রায় বন্ধ। সম্প্রতি শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মার নির্দেশে প্রচুর সুপারিও আটক হয়েছে শিলিগুড়িতে। দার্জিলিং জেলা পুলিশের এক কর্তাও জানান, চোরাচালানকারীদের যোগসাজশে বিস্ফোরক, নাশকতার সামগ্রী দেশে নেপাল থেকে ঢুকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্যই পুলিশের সব মহলের অফিসার-কর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বলে ওই কর্তা দাবি করেন। তাই সম্প্রতি মেচি পেরিয়ে নেপাল থেকে ঢোকা গরুর শরীরও মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, নেপাল সীমান্তে যে চোরাচালানে যুক্ত মহিলাদের অনেকেই মানছেন, আপাতত তাঁরা কারবার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। কাঁকরভিটা থেকে নিয়মিত নানা বিদেশি পণ্য মেচি পেরিয়ে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি ও শিলিগুড়ির বাজারে যাঁরা পৌঁছে দেন, সেই মহিলাদের কয়েকজন জানান, সীমান্তে নজরদারি থাকা অফিসার-কর্মীদের একাংশ তরফে ফি বছর ১৫ অগস্টের আগে ও পরে কয়েকদিন হাত গুটিয়ে রাখার অনুরোধ করে থাকেন। চোরাচালানে যুক্ত মহিলা দলের এক কর্ত্রী জানান, এবার ইয়াকুব মেমনের ফাঁসির সাজা কার্যকরের পরে কড়াকড়ি এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে চলতি মাসে ‘লাইন’ ঠিকমতো চালু হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
শিলিগুড়ির বিদেশি পণ্যের বাজারে যুক্ত ব্যবসায়ীদের একাংশের সূত্রেও জানা গিয়েছে, এক সপ্তাহ আগেও খানিকটা ঢিলেঢালা ছিল ভারত-নেপাল সীমান্তের নজরদারি। নানা কায়দায় ভিনদেশের সুপারি, এলাচ, আপেল নেপাল থেকে চোরাপথে ঢুকেছে শিলিগুড়িতে।
ওই ব্যবসায়ীদের কয়েকজন জানান, সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখেই আপাতত ‘লাইন’ বন্ধ থাকাটা মেনে নিতে হয়েছে। তবে পুজোর আগে ফের চোরাবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে ওই কারবারে যুক্ত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই আশা।