ছবি: সুব্রত চৌধুরী
আমার মনটা মোটেও শৃঙ্খলাপরায়ণ নয়। আর সেই সুবাদে স্মৃতিও শৃঙ্খলার ধার ধারে না, একেবারেই এলোমেলো। স্মৃতি যদি সুসংবদ্ধ হত, বড় ভাল হত, লাইব্রেরিতে যেমন ক্যাটালগের কার্ডগুলো পর পর গাঁথা থাকে। স্মৃতি সুবিন্যস্ত হলে ফেলে আসা জীবনের নানা অনুষঙ্গ, তার ইশারা কোথায় শুরু, সেখানে হয়তো পৌঁছে যাওয়া যেত।
তবু মাঝে মাঝে, মনের তো অনেকগুলি জানলা, তার মধ্যে কোনও একটা খুলে ভাবি, ছেলেবেলার সেই আবছা ভোরবেলাটা পাওয়া যাবে কি খুঁজে? সেই অস্পষ্ট হয়ে থাকা আশ্বিনের শারদপ্রাত?
ছবি ফোটার মতো আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে আসে মহালয়া, রেডিয়োর শব্দ, মহিষাসুরমর্দিনী।
আর আমার কাকা। রেডিয়োটা ছিল কাকার। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করার সুবাদে দূর দুর্গম মফস্সলে থাকতেন কাকা। ওই রেডিয়োটা সঙ্গে নিয়ে গেলে তাঁর একাকিত্ব খানিকটা কাটতে পারত। কিন্তু তা না করে আমাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ওটা রেখে দিয়েছিলেন কেন, তখন মাথাতেই আসেনি। যে সব জায়গায় কাকার পোস্টিং হত, তার অনেকগুলোতেই ইলেকট্রিসিটি যায়নি বলেই কি রেডিয়োটা তাঁর কাছে অনাবশ্যক হয়ে গিয়েছিল? বোধহয় না। শখ করে একটা দম দেওয়া গ্রামোফোনও কিনেছিলেন কাকা, সেটাও নিয়ে যাননি, কৃষ্ণনগরের বাড়িতেই পড়ে থাকত।
আসলে তখনকার দিনের মানুষজনের ভাবনাচিন্তাই একটু অন্য রকম ছিল। কাকা হয়তো ভাবতেন, আমি কিনেছি বলেই তো রেডিয়ো বা গ্রামোফোনটা আমার বদলির চাকরির সঙ্গী হওয়ার জন্য নয়— ওগুলো বাড়ির সকলের শোনার জন্য।
রেডিয়ো সেট মানে বাড়ির রেডিয়ো, সে তখন বাড়ির অলঙ্কার অহঙ্কার দুই-ই। আর সে জন্যেই সম্ভবত বাড়ির সকলের কথা ভেবে বা পরিবারের সকলের কথা ভেবে, এমনকী নানা বয়সের মানুষের কথা ভেবে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান তৈরি হত। গরিষ্ঠ ধর্মগোষ্ঠীর মনে রেডিয়ো-ব্যবস্থার জায়গাটা যাতে পাকাপাকি ভাবে তৈরি হতে পারে সে জন্যেও যে অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করা হত এটা অনুমান-নির্ভর নয়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ যে ওই রকম পরিকল্পনা নিয়েই তৈরি হয়েছিল, এ সব কথা অনেক পরে জেনেছি।
রাত কাটত না, অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের ভাইবোনদের জাগিয়ে দেওয়া হত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনার জন্যে। অন্য যে-কোনও দিন এমন ভোররাত্তিরে ঘুম থেকে উঠে পড়লে বকুনি শুনতে হত, আরও ঘুমোতে বলা হত। মহালয়ার দিন এই যে অন্ধকার থাকতে ডেকে দেওয়া হল তার কারণটা এই নয় যে বাগানের স্থলপদ্মগাছ থেকে কেউ ফুল চুরি করতে এসেছে, আমরা গেলে সে ছুট লাগাবে। আমাদের ডেকে তোলার পর বুঝতে পারতাম— ঘরের রেডিয়োটায় আলো জ্বলছে, একটা বাজনা বাজছে সেখানে, অধিবেশন শুরু হওয়ার বাজনা, পরে জেনেছিলাম ওটার নাম সিগনেচার টিউন।
মহালয়ার দিন ঘুমে-জাগরণে মেশা সেই ভোরে রেডিয়োতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতে শুনতেই যেন দুর্গোৎসব শুরু হয়ে যেত, তবে পুজোর উৎসবের থেকেও তা ছিল অনেক বেশি শরৎকালীন উৎসব। তিন বার শঙ্খধ্বনি দিয়ে শুরু হত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, বাণীকুমার পঙ্কজকুমার মল্লিক আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র— এই ত্রয়ীর সংরচনে অনুষ্ঠানটি যে অমন করে শরতের আবাহন হয়ে উঠতে পারে, তা জানে একমাত্র বাঙালিই।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আলেখ্যের শেষ দিকে যখন দুর্গার রণসজ্জার বর্ণনা করতে থাকেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ— কে কোন আয়ুধে দেবীকে সাজিয়ে দিলেন অসুর দলনের উপযুক্ত করে— সেই অংশ শুনতে শুনতে সুরাসুরের যুদ্ধকে যেন সব ভাল-মন্দ যুদ্ধের প্রতীক বলে মনে হত। মনে হত আমিও যেন সেই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত আছি। মন এক আদর্শের মধ্যে জেগে উঠত। সেই সঙ্গে এই বেতার সম্প্রচারের উপভোক্তা হয়ে অনতি-উষার লগ্নে আমাদের জেগে ওঠাটা যেন বালকবেলার খড়ির গণ্ডি পার করে নবলব্ধ এক অধিকারের মধ্যে আমাদের জাগিয়ে দিত।
শরতের এই উৎসবে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সকলকেই দেখতাম মেতে উঠতে। উৎসবের কত ক্রিয়াকাণ্ড, আমাদের কৃষ্ণনগর জুড়ে বসবাস করতেন যত সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁরা সকলেই ওই অনুষ্ঠানে থাকতেন, বিজয়ার পর দেখা করতেও আসতেন। গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতাম, তা তিনি হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান যেই হোন না কেন, মা-বাবা তেমনটাই শিখিয়েছিলেন।
বিসর্জনের দিন রাজবাড়ি থেকে প্রতিমার শোভাযাত্রা শুরু হত। রাজবাড়ির পুজো বাদে সবই বাড়ির পুজো। প্রতিমা কখনও কাঁধে তোলা হত না, তাতে শবদেহ বহনের অনুষঙ্গ আসে। চৌদোলায় চাপিয়ে নেওয়া হত, যেন পালকিতে প্রতিমা সংস্থাপন। শোভাযাত্রায় প্রথমেই রাজবাড়ির প্রতিমা, পিছনে পিছনে শহরের বাকি সমস্ত প্রতিমা। জলঙ্গী, আমাদের শান্ত নদীটি, তার ধারে এসে পৌঁছত শোভাযাত্রা। আগে থেকে ধরে রাখা একটা নীলকণ্ঠ পাখি খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেওয়া হত, যেন বা সে কৈলাসে উড়ে যাবে উমার প্রত্যাবর্তনের খবর নিয়ে।
দু’টো নৌকোর মধ্যে একটা পাটাতন জোড়া হত, তার ওপর প্রতিমা রেখে নিয়ে যাওয়া হত মাঝনদীতে। এক দিকে পুনরাগমনের মন্ত্রোচ্চারণ, ও দিকে দূরে নদীর বাঁকে জলের মধ্যে ডুবন্ত সূর্য। সেই অস্তগামী সূর্যের আলোয় জোড় খুলে দু’টো নৌকো দু’দিকে সরে যেত, জলের গভীরে নেমে যেত প্রতিমা, মাটি নিত জলের তলায়।
সঙ্গে সঙ্গে নদীর পাড়ে বিজয়ার আলিঙ্গনে ব্যস্ত হয়ে পড়ত সারা শহরের মানুষ। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীত আবেগ। সারা শহরের মানুষের কোলাকুলিতে যেন নতুন একটা কিছু শুরু হত, আবার বিসর্জিত প্রতিমা সেই দশমী দিবসে অনিবার্য শেষের কথাই মনে জাগিয়ে তুলত।
মনে হত এই বেদনার থেকে পালাই। দে ছুট, দে ছুট, তাহলে আমার মধ্যে বিসর্জনের যে অন্ধকারটা রয়েছে, যেটা এক আততায়ীর মতো বসে আছে, সে আর আমাকে ধরতে পারবে না। অতএব পালাও। দে ছুট, দে ছুট...
পালানোর সেই অভিপ্রায়, ইচ্ছে আজও যেন স্মৃতির মধ্যে ঘাই মেরে যায়।
সম্পাদনা: শিলাদিত্য সেন