কচুর পাতে ভাতের স্বপ্ন দেখেন কুপার্সের বৃদ্ধারা

টোল খাওয়া এনামেলের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছে কলমি শাক। ভেজা ডাল-পাতার জ্বালানিতে মাটির উনুনে তেমন আঁচ নেই। মরিয়া হয়ে ফুঁ দেওয়ার ফাঁকে মধ্য-ষাট মহিলা বলছেন, ‘‘দু’টো বুনো কচু পেয়েছি, শাকটা হয়ে গেলে মরা আঁচেই ফুটিয়ে নেব। নুন মেখে শাকে-কচুতে এ বেলাটা হয়ে যাবে।’’

Advertisement

রাহুল রায়

কুপার্স ক্যাম্প শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

শিবিরে অনাহার ক্লিষ্ট বৃদ্ধারা। সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

Advertisement

টোল খাওয়া এনামেলের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটছে কলমি শাক। ভেজা ডাল-পাতার জ্বালানিতে মাটির উনুনে তেমন আঁচ নেই। মরিয়া হয়ে ফুঁ দেওয়ার ফাঁকে মধ্য-ষাট মহিলা বলছেন, ‘‘দু’টো বুনো কচু পেয়েছি, শাকটা হয়ে গেলে মরা আঁচেই ফুটিয়ে নেব। নুন মেখে শাকে-কচুতে এ বেলাটা হয়ে যাবে।’’

Advertisement

বিভূতিভূষণের ‘পুঁইমাচা’ মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন জনা পনেরো বৃদ্ধা। শাক, কচু, মেটেআলু, কচ্চিৎ ফলনহারা কলাগাছের থোড়— গত মাস পাঁচেক ধরে কুর্পাস মহিলা উদ্বাস্তু শিবিরের ১৫ জন পুনর্বাসন না মেলা বৃদ্ধার দিন কাটছে পেটে কিল মেরে।

ঘন ঝোপের আড়ালে ভাঙা টিন-টালির নড়বড়ে অস্বাস্থ্যকর বসতে নিশ্চুপে মারাও গিয়েছেন অনেকে। শেষ সংযোজন বাসনা দাস। শিবিরের সুলতা বিশ্বাসের মনে পড়ে, ‘‘খেতে না পেয়ে বাসনাদির আর নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। মাস কয়েক আগে ঘরের মধ্যেই মরে পড়ে ছিল।’’ আগাছার জঙ্গল এখন সেই বাসনার ভাঙা ভিটে আগলে রেখেছে।

নদিয়া জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতর থেকে বরাদ্দ ছিল মাসে মাথা পিছু ৬ কেজি চাল, ৮ কেজি গম আর ৮০০ গ্রাম ডাল। ১৪ মাস আগে থেকে ডাল বন্ধ। গত জানুয়ারির এক দুপুরে বরাদ্দের চাল-গম শেষ বার নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতরের ভ্যান রিকশা। দিনটা স্পষ্ট মনে আছে মিনু রায়ের— ‘‘সে রাতে কী জাড় (শীত), তবে পেট ভরা ভাত খেয়ে ছিলাম তো, শীতের কামড় বুঝতে পারিনি!’’ দিন কয়েকের মধ্যে অবশ্য চাল ফুরিয়ে গিয়েছিল, কচু-কন্দের হাত ধরে ফিরেছিল শীত।

সরকারি বরাদ্দ বা ‘ড্রাই ডোল’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘কুপার্সের ওই বৃদ্ধাদের যে কার্যত ‘অনাহারে’ দিন কাটছে, প্রশাসনের কাছে তা তুলে ধরেছেন শাসকদলেরই দুই জনপ্রতিনিধি। ঠিক যেমন এক দশক আগে আমলাশোলে অনাহারে মৃত্যুর কথা লিখে জানিয়েছিলেন তদানীন্তন শাসকদলের এক পঞ্চায়েত সদস্য।

নদিয়ার শ্যামনগর পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য সুকান্ত মণ্ডলের কথায়, ‘‘বছর কয়েক ধরেই বরাদ্দ অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। গত পাঁচ-ছ’মাস হল তা একেবারে বন্ধ। দিন কয়েক আগে ওই শিবিরে গিয়ে দেখি, মেটে আলু আর কন্দ খেয়ে বেঁচে রয়েছেন ওঁরা। শুনলাম, মারাও গিয়েছেন এক জন।’’

ওই পঞ্চায়েতের গা ঘেঁষেই কুপার্স নোটিফায়েড এলাকা। সেখানকার ভাইস-চেয়ারম্যান, তৃণমূলের পিন্টু দত্তের অভিজ্ঞতা, ‘‘কুপার্সের পিএল (পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি) ক্যাম্পের বেশ কয়েকটি পরিবারেরও একই হাল। বলতে লজ্জা হয়, প্রতিবেশী পরিবারগুলি অনাহারে, অথচ আমরা এত দিন তা জানতেই পারিনি।’’

অথচ সরকারি বরাদ্দ কেন বন্ধ তা জানেনই না উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী। যাঁর লক্ষাধিক টাকা দামের চশমা নিয়ে ক’দিন আগে বিধানসভায় হইচই হয়েছে, সেই সাবিত্রী মিত্র শুধু ‘খোঁজ নিয়ে দেখছি’ বলেই দায় সেরেছেন।

দেশভাগের সময়ে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের অনেকেই পরিবার-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অনেকেই হারিয়েছিলেন পরিবার। হারানো স্বজনের খোঁজ আর মেলেনি। বিচ্ছিন্ন সেই সব উদ্বাস্তুর ভিড়ে মহিলাদের সংখ্যা কম ছিল না। অনেকেই ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। সেই মহিলাদের নিয়েই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের নির্দেশে ‘মহিলা আশ্রয় শিবির’ গড়ে তুলেছিল উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দফতর। নদিয়ার রানাঘাট, ধুবুলিয়া, চাঁদামারি, চামটার সঙ্গে কুপার্সও ছিল সেই তালিকায়।

কুপার্সের পুরনো বাসিন্দাদের অনেকে মারা গিয়েছেন। পরিবারহারা অন্তত সাত মহিলার ওই শিবিরেই প্রসব হয়েছিল। পুনর্বাসনের আশায় বুক বেঁধে তাঁরা আর ঠিকানা বদলাতে পারেননি। পুনর্বাসন আইন অনুসারে কয়েক কাঠা জমি, সরকারি প্রকল্পের বাড়ি তাঁদের প্রাপ্য। স্বাধীনতার ৬৮ বছরেও সে ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি রাজ্য সরকার। কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল— কেউ না। ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিলের সম্পাদক অশোক চক্রবর্তীর আক্ষেপ, ‘‘সাকুল্যে ১৫টা পরিবার। তাদের সামান্য জমিতে পুনর্বাসন দিয়ে স্বনির্ভর করে তুলতে পারলে সরকারের এ ভাবে মুখ পুড়ত না।’’

মাস কয়েক আগে সাবিত্রীদেবী নিজেই কিন্তু কুপার্সে গিয়েছিলেন। মহিলা শিবিরের পাঁচ দশকের বাসিন্দা গীতা দাস বলেন, ‘‘আমরা কেমন আছি, মন্ত্রী তা নিজের চোখে দেখে গিয়েছেন। তাঁর আশ্বাস সত্ত্বেও চাল আসেনি। তবে শৌচালয় গড়া হয়েছে। পেটে দানা নেই, শৌচালয় নিয়ে কী করব?’’ বরাদ্দ আসছে না কেন? মন্ত্রী বলেন, ‘‘বুঝতে পারছি না। আপাতত স্থানীয় প্রশাসনকে চাল-গমের ব্যবস্থা করতে বলেছি। দফতর থেকে আমরা তার দাম মিটিয়ে দেব।’’

বরাদ্দ বন্ধ নিয়ে মুখে কুলুপ পুনর্বাসন দফতরের কর্তাদেরও। জেলা পুনর্বাসন আধিকারিক অশোক মণ্ডলের দাবি, ‘‘মাস সাতেক আগে জেলা খাদ্য নিয়ামকের দফতর থেকে জানানো হয়, উদ্বাস্তু শিবিরের বরাদ্দ আপাতত দেওয়া যাচ্ছে না। খোলা বাজার থেকে চাল-ডাল কিনে মাস দুয়েক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলাম আমরা।’’ তার পরে তা-ও থমকে গিয়েছে। খাদ্য ও সরবরাহ দফতরের কর্তারা অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

ভুখা পেটে বৃষ্টি মাথায় কচু-কন্দ খুঁজতে থাকা কাদা মাখামাখি বৃদ্ধারা এখন আর পুনর্বাসনের স্বপ্ন দেখেন না। এমনকী সরকারি বরাদ্দ কেন বন্ধ হল, সেই খোঁজটুকু নেওয়ার শক্তিও তাঁদের নেই। সত্তরোর্ধ্ব কমলা দাস লাঠিতে থুতনি রেখে বলছেন, ‘‘টিনের আড়ালে আধমরা হয়েই তো চৌষট্টি বছর কাটিয়ে দিলাম। এখন চোখ বুজলে দেখতে পাই শুধু এক থালা গরম ভাত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন