নির্যাতনে পাশে আছে আইন

বড় ছেলে ও মেয়েরা বারবার ডাকা সত্ত্বেও স্নেহের বশে নিঃসঙ্গ ছোট ছেলেকে একা ছেড়ে যাননি বাঁকুড়ার কদমাঘাটির বৃদ্ধা আশা বাউরি। তবে ছোট ছেলের মদ খাওয়ায় তাঁর আপত্তি ছিল। ছেলে যাতে নেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে রোজগেরে হয় তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালাতেন। আর সেটাই কাল হল।

Advertisement

সমীর দত্ত ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

মানবাজার ও বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০০:৫২
Share:

বড় ছেলে ও মেয়েরা বারবার ডাকা সত্ত্বেও স্নেহের বশে নিঃসঙ্গ ছোট ছেলেকে একা ছেড়ে যাননি বাঁকুড়ার কদমাঘাটির বৃদ্ধা আশা বাউরি। তবে ছোট ছেলের মদ খাওয়ায় তাঁর আপত্তি ছিল। ছেলে যাতে নেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে রোজগেরে হয় তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালাতেন। আর সেটাই কাল হল। একদিন রাতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাড়ির ভিতরেই কুপিয়ে মাকে খুন করার অভিযোগ উঠল সেই ছেলের বিরুদ্ধে!

Advertisement

অন্যদিকে বাঁকুড়ার পাঁচবাগার বাসিন্দা বৃদ্ধা মণি কুম্ভকারের উপর তাঁর একমাত্র ছেলে বিশ্বনাথ কুম্ভকারের অতাচারের ঘটনা অজানা ছিল না এলাকাবাসীর। শেষ পর্যন্ত মাকে খুন করে বাড়ির আঙিনাতেই পুঁতে ফেলার অভিযোগে ধরা পড়ে সেই ছেলে বিশ্বনাথ।

গত জুলাই মাসে বাঁকুড়া শহর সংলগ্ন এলাকায় চারদিনের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া এই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা বাঁকুড়া জেলায় প্রবীণদের পরিবারে নির্যাতিত হওয়ার ঘটনাকে সামনে এনে তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল।

Advertisement

পড়শি জেলা পুরুলিয়াতেও বয়স্ক মানুষদের উপর নির্যাতনের ঘটনা বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। মানবাজারের বহরতোড় গ্রামের সত্তর ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ রবিলোচন গড়াইকে সস্ত্রীক তাঁর নিজের বাড়ি থেকে মারধর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল দুই ছেলে। পালিয়ে কয়েকটা রাত বাঁকুড়া স্টেশনে তাঁরা রাত কাটাচ্ছিলেন। পরে আশ্রয় পান মেয়ের কাছে। আদালতের শরণাপন্ন হন রবিলোচনবাবু। এরপরে পুলিশ ও প্রশাসন রবিলোচনবাবুর দুই ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বাড়িতে ফেরান। অন্যদিকে, তিন ছেলে সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা দেখেন না বলে অভিযোগ তুলে বিডিও-র দ্বারস্থ হয়েছিলেন বলরামপুরের বৃদ্ধা পুষ্পবালা পাল। তাঁকে একটি চালাঘরে একাকী দিন কাটাতে হচ্ছিল। ঠাঁইনাড়া হওয়া এই সমস্ত মানুষদের একমাত্র সহায় প্রশাসন। রয়েছে আইনও। কিন্তু তবু বয়স্কদের উপর নির্যাতন ঠেকানো যাচ্ছে না।

সে আঁচ পাচ্ছেন বাঁকুড়ার সরকারি আইনজীবী (পাবলিক প্রসিকিউটর) রীনা চক্রবর্তীও। তাঁর মতে, ‘‘পারিবারিক নির্যাতনের বিচার চেয়ে বাঁকুড়ার আদালতগুলিতে আসা প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা বাড়ছে।’’ পুরুলিয়া আদালতের আইনজীবী দেবদত্ত মুখোপাধ্যায়ও জানাচ্ছেন, বাঁকুড়ার মতোই পুরুলিয়া আদালতেও নানা ভাবে নির্যাতিত হয়ে বিচারের জন্য আসতে দেখা যায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। তবে অনেক ঘটনা আবার আদালত পর্যন্তও গড়ায় না। তিনি বলেন, “বহু বাবা-মা লোকলজ্জার খাতিরে বা নিজেদের ছেলের স্বার্থে আদালতে না এসে পুলিশের মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।”

জেলা আইনি পরিষেবা কেন্দ্র বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত সচেতনতা শিবির করে বয়স্কদের অধিকার নিয়ে বোঝাচ্ছে। বাঁকুড়া জেলা আইনি পরিষেবা কেন্দ্রের সম্পাদক দুর্গাশঙ্কর রানা বলেন, ‘‘বয়স্ক মানুষদের উপর অত্যাচারের ঘটনা কি শহর, কি গ্রাম— সব জায়গা থেকেই শোনা যাচ্ছে। ধনী পরিবারে যেমন ঘটছে, তেমনই নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারেও নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বাঁকুড়া জেলায় ফি মাসে প্রবীণদের উপর নির্যাতনের কমবেশি ১০টি ঘটনা উঠে আসে। কোথাও মা-বাবাকে রান্নাঘরে বেঁধে রেখে খেতে না দেওয়ার অভিযোগ, কোথাও আবার এলাকার বয়স্ক মানুষদের ডাইনি অপবাদে মারধরের মতো অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।’’

তিনি জানান, ছেলেরা বাবা-মাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে এমন অভিযোগ আকছার উঠছে এই জেলায়। সরকারি কর্মী থেকে দিনমজুর, সমস্ত স্তরের মানুষের বিরুদ্ধেই বাবা-মায়ের উপর নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই সব সমস্যা নিয়ে বয়স্ক মানুষজন তাঁদের কাছে এলে তাঁরা বিনামূল্যে আইনি সাহায্য দিচ্ছেন বলে দুর্গাশঙ্করবাবু জানাচ্ছেন।

বয়স্কদের উপর নির্যাতন রুখতে কী করছে প্রশাসন? এক্ষেত্রে অবশ্য আশার কথা শোনাচ্ছে বাঁকুড়া জেলা পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘‘সিভিক ভল্যান্টিয়ার ও ভিলেজ পুলিশকেদ কাজে লাগিয়ে প্রতিটি অঞ্চলের খুঁটিনাটি খবর আমাদের কাছে পৌঁচচ্ছে। তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে কোথাও প্রবীণ নাগরিকদের উপর নির্যাতনের খবর পেলে ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারকে তা জানাতে হবে। তখন পুলিশই ব্যবস্থা নেবে।’’ প্রবীণদের সমস্যা মেটাতে আরও কিছু করা যায় কি না তা নিয়েও ভাবছে জেলা পুলিশ।

পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী জানান, প্রবীণ মানুষেরা নির্যাতিত হয়ে প্রশাসনের দ্বারস্থ হলে মহকুমাশাসকেরা দ্রুত ব্যবস্থা নেন। এক্ষেত্রে তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বাঁকুড়া জেলা সমাজ কল্যাণ আধিকারিক সুরেন্দ্রপ্রসাদ ভকত বলেন, ‘‘জেলায় বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রয়েছে যারা প্রবীণ মানুষদের নিয়ে কাজ করে। ওই সব সংস্থাগুলিকে প্রশাসন কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন ভাবে। জেলার অন্যতম একটি সমস্যা হল প্রবীণদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য সরকারি কোনও হোম বা বৃদ্ধাশ্রম নেই। জেলাতে বেসরকারি বৃদ্ধাশ্রমও খুবই কম।’’

তিনি জানাচ্ছেন, সমস্যাটি জেলা প্রশাসনের নজরে রয়েছে। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে প্রবীণদের হোম বা বৃদ্ধাশ্রম গড়া নিয়ে আলোচনা চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন