বাইকের পিছনে চেপে চোখ সংগ্রহ করে ফিরছেন দুই চিকিৎসক। বাঁদিকে ঋতম খান, ডানদিকে শুভেন্দু হাজরা। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র।
একটা সিনেমা। অন্যটা বাস্তব।
সিনেমায় স্কুটিতে চাপিয়ে মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন আমির-করিনা। সে যাত্রায় প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল ওই বৃদ্ধের।
বৃহস্পতিবার কলকাতা দেখল মোটরবাইকে চেপে চলেছেন দুই তরুণ চিকিৎসক। যে করেই হোক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য পৌঁছতে হবে নার্সিংহোমে। না হলে এক বৃদ্ধার পরিবারের ইচ্ছা পূরণ করা যাবে না। তোলা যাবে না তাঁর দুটি চোখ। বঞ্চিত হবেন দু’জন মানুষ, যাঁরা কর্নিয়ার জন্য দীর্ঘদিন নাম লিখিয়ে বসে আছেন।
সিনেমায় আমির ও করিনার কাছে প্রতিবন্ধকতাটা ছিল যানজটে জেরবার শহরে বন্ধুর অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া। আর বৃহস্পতিবার তৃণমূলের শহিদ দিবসের সমাবেশে অবরুদ্ধ উত্তর ও মধ্য কলকাতায় ওই দুই ডাক্তারের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল যে ভাবেই হোক কর্নিয়া দু’টি সংগ্রহ করা।
২১শে জুলাইয়ের জমায়েতকে কেন্দ্র করে এ দিন সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছিল। অবরুদ্ধ ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ। বিডন স্ট্রিটের একটি নার্সিংহোমে এ দিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মারা যান শ্যামবাজারের ইলা সাহা (৭৩)। তাঁর পরিবারের লোকেরা চেয়েছিলেন, ইলাদেবীর চোখ দু’টি দান করতে। সেই মতো তাঁরা যোগাযোগ করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি (আরআইও)-তে। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হয়, রাস্তার যা অবস্থা, তাতে গাড়ির ব্যবস্থা করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছনো অসম্ভব। তবে বিকল্প ব্যবস্থা হলে অবশ্যই চেষ্টা করবেন।
কী সেই বিকল্প ব্যবস্থা? ডাক্তাররা জানান, এ ক্ষেত্রে একটাই যান মুশকিল আসান হয়ে উঠতে পারে, আর তা হল মোটরবাইক। সেইমতো দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে মেডিক্যাল কলেজে বাইক নিয়ে পৌঁছলেন মৃতার আত্মীয়রা। ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে তখন রোগী দেখছিলেন দুই চিকিৎসক ঋতম খান এবং শুভেন্দু হাজরা। দ্রুত অন্য চিকিৎসকদের আউটডোরের দায়িত্ব বুঝিয়ে মোটরবাইকে সওয়ার হন তাঁরা। সওয়া দুটোয় নার্সিংহোম পৌঁছন। পৌনে তিনটেয় চোখ সংগ্রহ করে ফিরতি পথ ধরেন। তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে পরিবারের লোকেরা ইলাদেবীর শেষকৃত্যের জন্য রওনা হন নিমতলা শ্মশানে।
দিন কয়েক আগে এই শহরেই মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন শোভনা সরকার নামে এক বৃদ্ধার পরিজনেরা। যেখানে মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদানের বিষয়ে সরকারি তরফেই কোনও সক্রিয়তা তৈরি হয়নি, সেখানে একটি পরিবারের এমন উদ্যোগ নজির তৈরি করেছিল গোটা রাজ্যেই। শোভনাদেবীর দু’টি কিডনি সেই রাতেই প্রতিস্থাপিত হয় রেনাল ফেলিওরের দুই রোগীর শরীরে। তাঁর দু’টি কর্নিয়ায় দৃষ্টি ফিরে পান আরও দু’জন।
ইলাদেবীর ভাইপো বীরেন সাহা এ দিন জানালেন, তিনি নিজে মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। কাকিমার মৃত্যুর খবর পেয়ে মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। ওই সংগঠন মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুর পরে চোখ সংগ্রহ নিয়ে মৃতের পরিবারের কাউন্সেলিং করে। সংগঠনের তরফে ভাস্কর সিংহ বলেন, ‘‘এক একটি কর্নিয়া আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান। সেখানে চোখ দান করতে গিয়ে কোনও পরিবার ব্যর্থ হবে, তা মেনে নেওয়া কঠিন। এ দিনের রাস্তার প্রতিকূলতাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কাজটা সফল হয়েছে, তার কারণ টিমওয়ার্ক।’’
একই কথা বলেছেন আরআইও-র শিক্ষক-চিকিৎসক হিমাদ্রি দত্ত। তিনি বললেন, ‘‘সমস্ত রাস্তাঘাট বন্ধ। হাসপাতালে গাড়ির ব্যবস্থাও করা যেত না। তাই এই পথটা ভাবতে হয়েছিল। কাজটা ঠিকমতো হওয়ায় খুব ভাল লাগছে।’’ এই তৃপ্তির কথাই শোনা গিয়েছে দুই তরুণ চিকিৎসক ঋতম ও শুভেন্দুর মুখেও। তাঁদের কথায়, ‘‘কত মানুষ চোখের জন্য অপেক্ষা করেন। পর্যাপ্ত কর্নিয়ার অভাবে আমরা তাঁদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারি না। সেখানে দু’টো কর্নিয়া এ ভাবে নষ্ট হবে, তা মানতে পারিনি।’’
কলকাতার মানুষের এই সমবেত প্রয়াসকে স্বাগত জানিয়েছেন রাজ্যে মরণোত্তর চক্ষুদান আন্দোলনের পুরোধা, সমাজকর্মী ব্রজ রায়। তাঁর কথায়, ‘‘ আরও এক বার এই শহরের মানুষের সদিচ্ছার প্রমাণ দিল।’’