বর্ণ-পরিচয়: অভিভাবকদের লিখতে শেখানোর কর্মসূচি জঙ্গিপুরের জোতকমল হাইস্কুলে। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
বিড়ম্বনাই বটে!
দু’বার পেনসিল ভেঙেছেন। ইরেজার হারিয়েছেন তিন বার। তার পরে বহু মোছামুছির পরে ‘অ’ থেকে ‘ঊ’ লেখা শেষ হল। কিন্তু ‘ঋ’-কে কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না তিনি। তাঁর মনে হচ্ছে, বইয়ের ঋষিমশাইও যেন ধ্যান ভেঙে তাঁর এই দশা দেখে হাসছেন!
বছর পঁয়ত্রিশের নিবেদিতা হালদার কাঁচুমাচু মুখে বলছেন, ‘‘এই বয়সে আমার দ্বারা এ সব আর হবে না।’’ সদ্য পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া মেয়ে লিজা তখন কড়া শিক্ষিকা। মায়ের চোখে চোখ রেখে সে বলছে, ‘‘শোন মা, হাল ছাড়লে চলবে না। ‘অ’ থেকে ‘ঊ’ যখন পেরেছ, বাকিটাও পারবে। নইলে নাম সই করবে কী করে?’’ বাধ্য ছাত্রীর মতো ফের ‘ঋ’-এর উপরে পেনসিল বুলোতে শুরু করলেন নিবেদিতা। পাশের বেঞ্চে বসে সঞ্জয় হালদার আবার বলছেন, ‘‘বলেছিলাম, শুধু সইটা শিখিয়ে দিতে। কিন্তু ছেলে বলছে ‘অ’ থেকে চন্দ্রবিন্দু শেষ করতেই হবে।’’
মঙ্গলবার দুপুরে এমনই উলটপুরাণের সাক্ষী থাকল মুর্শিদাবাদের জোতকমল হাইস্কুল। জঙ্গিপুরের ১১২ জন অভিভাবকের এ দিন থেকেই শুরু হল বর্ণ পরিচয়। স্কুল-প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষক শিবশঙ্কর সাহা মুচকি হাসছেন, ‘‘টিপসইয়ের দিন শেষ। এ বার স্কুলের সমস্ত অভিভাবককে সই করতে হবে। সে দায়িত্বও নিয়েছে স্কুলের পড়ুয়ারাই।’’
আরও পড়ুন: ফুটবলের স্বপ্নে মশগুল মেয়েরা
সম্প্রতি ওই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ২৮৪ জন পড়ুয়া ভর্তি হয়েছে। তাদের ভর্তি করাতে এসে এই ১১২ জন অভিভাবক টিপসইয়ের জন্য কালি চেয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ গোঁ ধরেন, সই-ই করতে হবে। আকাশ থেকে পড়েন ওঁরা, ‘‘তা কী করে সম্ভব! আমরা তো লেখাপড়াই জানি না।’’
আরও পড়ুন: ‘মারের’ প্রতিবাদে সার দিয়ে বন্ধ চাকা
মুশকিল আসান করে দেন শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। তাঁরা জানান, ছেলেমেয়েকে তাঁরা ভর্তি নেবেন। কিন্তু ফর্মে ‘অভিভাবকের স্বাক্ষর’-এর জায়গাটা ফাঁকা থাকবে। সই শেখার পরে সেই শূন্যস্থান পূরণ হবে। সেই মতো এ দিন থেকে শুরু হয়েছে ওঁদের ‘ক্লাস’। স্কুলের তরফে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বই, পেনসিল, ইরেজার। আগামী দু’মাস ধরে ফি শনিবার স্কুল ছুটির পরে চলবে অক্ষর-অনুশীলন। জুলেখা বিবি, প্রার্থনা হালদারেরা বলছেন, ‘‘টিপসই দিতে আমাদেরও লজ্জা লাগে। এ বার থেকে আর কালির বাক্স নয়, কলম চাইব।’’