সুধাংশু শীল
জোড়াবাগানের সঙ্গে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের দূরত্ব ইদানীং বাড়ছিল। জল্পনা চলছিল ইতিউতি। তা বলে উত্তর কলকাতা থেকে সোজা আফ্রিকা? নির্ভেজাল বাঙালি আ়়ড্ডা ছেড়ে খটমট পর্তুগিজ ভাষার সুলুকসন্ধানে মনোনিবেশ? অভাবনীয় এক যাত্রায় বেরিয়ে পড়ছেন বছর সত্তরের এক বাঙালি কমরেড!
পাড়া-পড়শিদের কাউকেই খবরটা এখনও জানাননি।
পঞ্চাশ বছর যে দলের হাত ধরে রাজনীতি করছেন, সেই দলের সহকর্মীদের কাছেও খবরটা গোপন রেখেছেন। কেবল দলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যকেই মনের গোপন বাসনার কথা খোলসা করেছেন। উত্তর কলকাতার নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের ঠিকানা ছেড়ে এ বার সুদূর আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলায় আস্তানা গাড়তে চলেছেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ সুধাংশু শীল! আগামী সেপ্টেম্বরে কাজ বুঝে নিতে তাঁর সে দেশে যাওয়ার কথা। তবে পুজোর পরে পাকাপাকি অ্যাঙ্গোলাতেই আস্তানা গাড়ছেন জোড়াবাগান-শোভাবাজার এলাকার পরিচিত মুখ ‘মিন্টু’দা। কেন? মিষ্টি হেসে তাঁর উত্তর, ‘‘যে স্বপ্ন পূরণ করতে ৫০ বছর ধরে পার্টিটা করছি, তা কার্যকর করতেই অ্যাঙ্গোলা যাচ্ছি।’’
কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর থেকে মেয়র পারিষদ হয়েছিলেন। মেয়র পারিষদ থাকাকালীনই জোড়াবাগান কেন্দ্র থেকে সিপিএমের বিধায়ক এবং বিধায়ক থাকাকালীনই একদা কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ হয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে পুরসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে অবশ্য আর কাউন্সিলর হওয়া হয়নি। এ রাজ্যে সিপিএমের কপাল যখন অনিশ্চিত, তখন কি নিজের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতেই তিনি চলেছেন অ্যাঙ্গোলায়? সুধাংশুবাবু বলেন, ‘‘পার্টি এক দিন না এক দিন ঘুরে দাঁড়াবেই। ঘুরে দাঁড় করানোর নেতা পার্টিতে অনেকেই আছেন। গরিব-মেহনতি মানুষ আমাদের থেকে যে কোনও কারণেই হোক সরে গিয়েছে। তাদের ফেরাতে তো সময় লাগবে!’’
এ বার হেরে যাওয়ার আগে গত পাঁচ বছর কলকাতা পুরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন সুধাংশুবাবু। সেই সময়েই বেলেঘাটায় সরকারি ওয়্যারহাউসিং কমপ্লেক্সে তাঁর এক বন্ধুর ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর সেই কর্মক্ষেত্রে বসেই সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে সুধাংশুবাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘১৯৬৩ সাল থেকে পার্টির টুকটাক কাজ শুরু করেছি। দলের সদস্য হয়েছি ’৯০ সালে। আমি যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, তা বাস্তবায়িত করার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু অ্যাঙ্গোলায় এখন যে সরকার এসেছে, তা বামপন্থীদের সমমনোভাবাপন্ন। ওখানকার সরকার মেহনতি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তাতে সহযোগিতা করতেই আমার অ্যাঙ্গোলা যাত্রা!’’
বিধায়ক এবং সাংসদ থাকাকালীন সুধাংশুবাবু রাজ্য থেকে বিদেশের বাজারে ফুল ও কৃষিজাত পণ্য এবং রেডিমেড পোশাক, হোসিয়ারি দ্রব্য রফতানি করার কাজেও উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর কাজের হদিশ রাখতেন আইটিসি-র প্রাক্তন আধিকারিক দেব পি বড়ুয়া। তিনি এখন যে সংস্থা চালান, তার দফতর রয়েছে লন্ডন এবং অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডায়। ওই সংস্থা অ্যাঙ্গোলার উন্নয়নে সরকারকে সহযোগিতা করছে। আড়াই কোটি লোকের দেশ অ্যাঙ্গোলায় যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও তারা ছিল মূলত আমদানি নির্ভর। এখন চিন, ভিয়েতনামের মতো কমিউনিস্ট দেশগুলিকে পাশে পেয়ে অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইছে অ্যাঙ্গোলার সরকার। কিন্তু সেখানে তাঁর ভূমিকা কী?
সুধাংশুবাবুর বক্তব্য, তিনি ও’দেশের সরকারের ‘কো-অর্ডিনেটর’ হিসাবে এ দেশের শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘ইতিমধ্যেই বেঙ্গালুরুর এক বস্ত্র ব্যবসায়ী ওখানে প্ল্যান্ট স্থাপনে রাজি হয়েছেন। ওখানকার সরকার বিনা পয়সায় জমি দেবে। এখান থেকে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা দক্ষ কারিগর নিয়ে যাবেন, তেমনই ওদের দেশের মানুষকেও শিখিয়ে-পড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চায় অ্যাঙ্গোলা সরকার।’’এখানকার মানুষও কমর্সংস্থানের সুযোগ পাবে জেনে সুধাংশুবাবুর ঘনিষ্ঠ সিপিএম নেতা তাঁকে বলেছেন, ‘‘ভালই তো! এখানে তো স্রেফ ভাঁওতা চলছে!’’ তার মানে বাংলার শিল্পের খরা কাটাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লন্ডনের রাস্তায় হাঁটছেন, তখন তাঁরই রাজ্যের সুধাংশুবাবু এখানকার ব্যবসায়ীদের অ্যাঙ্গোলায় টানার পরিকল্পনা করছেন? সুধাংশুবাবুর সহাস্য জবাব, ‘‘ধুর! ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা বাংলার উন্নয়নে আন্তরিক। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ মিলছে না বলে বিনিয়োগ হচ্ছে না।’’
পুজোর পরে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই অ্যাঙ্গোলাবাসী হতে চান সুধাংশুবাবু। মেয়ে বিবাহিতা, ছেলে এখানে কর্মরত। তবে আদরের নাতনি উদিতার সঙ্গে আর প্রতি দিন দেখা হবে না বলে কষ্টও আছে বিস্তর! কষ্ট জয় করেই স্বপ্নপূরণে যেতে চান উত্তর কলকাতার সাবেক বাঙালি রাজনীতিক।