প্রতীকী ছবি।
দু’মাসের বেশি সময় ধরে চলা বন্ধের জেরে বেতন তুলতে পারছেন না। সঞ্চয়ের টাকায় কত দিন চলবে এই ভাবনায় যখন রাতের ঘুম চলে যাওয়ার জোগাড় তখন কিন্তু পাশে এসে প্রথম দাঁড়িয়েছিল পাশের নেপালি পরিবারটিই। যাদের সঙ্গে রোজের আড্ডা, আশ্বস্ত করেন সেই নেপালি বন্ধুরাও। তাঁদেরই টানে সমস্ত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এখনও পাহাড়ে রয়ে গেছেন বাঙালি স্কুল শিক্ষক।
পাহাড়ের এক ব্যবসায়ী জানালেন, চাল, ডাল কোথায় মিলবে তার সুলুকসন্ধান দিচ্ছেন এক সাথে বেড়ে ওঠা তাঁর নেপালি বন্ধুরাই। বললেন, ‘‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে খরিদ্দার সামাল দিতে হিমশিম খেতাম। আর এখন ঘরে বসে হাঁফিয়ে উঠছি। কোনও কাজ নেই। ভরসা আমার পড়শিরাই।’’
আরও পড়ুন: বাংলা ভাগের বিরোধিতায় মিছিল
কাঞ্চনজঙ্ঘা, টয়ট্রেন, টাইগার হিল নিয়ে যে দার্জিলিং জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির সঙ্গে সেখানেই কয়েক পুরুষ ধরে বাস করছেন এরা। সপ্তাহান্তে ছুটি কাটিয়ে সমতল মুখো হওয়া নয়, বরং শৈল শহরের সমস্ত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে জড়িয়ে নিয়েই বেড়ে ওঠা তাঁদের। কারও পেশা ব্যবসা, কেউ চিকিৎসক, কেউ বা পাহাড়ের স্কুলেই শিক্ষকতা করছেন। কেউ সরকারি চাকুরে। সমতলের বাঙালিদের মতোই তাঁরাও দল বেঁধে দুর্গাপুজোর চাঁদা তোলেন। অষ্টমীর অঞ্জলি দেন, ভোগ খাওয়া হয়, ধুনুচি নৃত্য হয়। পাশাপাশি পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণে হয় কবি স্মরণ। অনেকেই পরবর্তীতে সমতলে নেমে গেলেও এখনও ৫০টির মতো বাঙালি পরিবার রয়ে গিয়েছেন দার্জিলিঙে।
যাঁরা চলে গিয়েছেন পাহারি পথের পাকদণ্ডীতে তাঁদের স্মৃতি নিয়ে থেকে গিয়েছে বাড়িগুলি। জলাপাহাড়ে জগদীশচন্দ্রের ‘মায়াপুরী’, লেবংকার্ট রোডে দ্বারকানাথ রায়ের ‘রয়ভিলা’, মলের কাছে নৃপেন্দ্রনাথ রায়ের ‘স্টেপ অ্যাসাইড’, শরৎচন্দ্র দাসের ‘লাসা ভিলা’। কার্শিয়াঙের বাঙ্গালি বাড়ির কর্তাটি বললেন, ‘‘ভোররাতেই শিলিগুড়ি নামতে হচ্ছে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে একটু রাতে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে ফিরতে হচ্ছে। আশেপাশের নেপালি পড়শিদেরওতো হেঁসেল ফাঁকা। তাই তাদেরও কিছু কিছু আটা, চিনি বিলি করি।’’ রাজরাজেশ্বরী হল পুড়ে যাওয়ায় ব্যাথিত পড়শিদের লম্বা তালিকাও দিলেন তিনি। তাঁরা অনেকেই যে বলছেন, ‘‘এত বড় ক্ষতি স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ করবে না। এই অন্যায় করল কে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।’’
বন্ধের কোপে পাহাড়ের স্কুল কলেজও। ঘরে পড়ুয়াদের নিয়ে তাই বিপাকে বাসিন্দারা। দুই সন্তানের পিতা বললেন, ‘‘বাঙালি শিক্ষকরা প্রায় সবাই সমতলে নেমে গিয়েছেন। এখন স্থানীয় শিক্ষক শিক্ষিকারাই তো ভরসা।
বাংলা ছাড়ার জোরদার আওয়াজ উঠেছে পাহাড়ে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে জ্বলছে পাহাড়। তবুও অসহিষ্ণুতার বালি সরালেই সম্প্রীতির এই ফল্গুধারাও কিন্তু নজর এড়ায় না।