এমবিবিএস-২০১৬

না-শিখেই ডিগ্রি, আশঙ্কায় এমসিআই

হবু চিকিৎসকদের গুণগত মান কী ভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে গোল বেঁধেছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) এবং তাদের উপর নজরদারির জন্য সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া তিন সদস্যের ওভারসাইট কমিটির মধ্যে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৩৮
Share:

হবু চিকিৎসকদের গুণগত মান কী ভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে গোল বেঁধেছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) এবং তাদের উপর নজরদারির জন্য সুপ্রিম কোর্টের গড়ে দেওয়া তিন সদস্যের ওভারসাইট কমিটির মধ্যে।

Advertisement

এমসিআইয়ের ব্যর্থতায় দেশে মেডিক্যাল শিক্ষার মান ও ডাক্তারের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে বলে চলতি বছরের গোড়ায় রিপোর্ট দিয়েছিল সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি। তাদের সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট এমসিআইয়ের কাজে নজরদারির জন্য বিচারপতি আর এম লোঢা-র নেতৃত্বে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই ওভারসাইট কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন ‘ইনস্টিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলিয়ারি সায়েন্সেস’-এর অধিকর্তা চিকিৎসক শিবকুমার সারিন এবং দেশের প্রাক্তন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বিনোদ রাই।

এই কমিটির সঙ্গে এমসিআইয়ের মূল বিরোধ তৈরি হয়েছে দেশের ৬৩টি মেডিক্যাল কলেজকে ডাক্তারি পড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া নিয়ে। এমসিআই-এর বক্তব্য, পরিকাঠামোর অভাব থাকায় চলতি শিক্ষাবর্ষে ওই মেডিক্যাল কলেজগুলিতে এ বার ছাত্র ভর্তির অনুমোদন দেয়নি তারা। কিন্তু তার তোয়াক্কা না-করেই সেগুলিতে শর্তাধীনে ডাক্তারি পড়ানোর অনুমতি দিয়ে দিয়েছে নয়া নজরদারি কমিটি। পরিকাঠামো উন্নয়নের নামে ছাত্র ভর্তির সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে বলে এমসিআই-এর অভিযোগ।

Advertisement

এমসিআই-এর একাধিক কর্তার অভিযোগ, যথেষ্ট পরিকাঠামো না-থাকা সত্ত্বেও শুধু চিকিৎসকের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদে ওভারসাইট কমিটি ওই সব নিম্ন মানের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজকে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। এমসিআইয়ের আশঙ্কা, লক্ষ-লক্ষ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে ওই সব মেডিক্যাল কলেজ থেকে যাঁরা ডাক্তারি পাশ করে বেরোবেন, তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণই থাকবে না। থাকবে না রোগী দেখার অভিজ্ঞতাও।

এমসিআইয়ের প্রধান জয়শ্রী বেন মেটার কথায়, যে কলেজগুলিকে এমসিআই অনুমতি দেয়নি, তাদের বেশির ভাগেরই হাসপাতাল বলে কিছু নেই। শুধু ঝাঁ-চকচকে ভবন রয়েছে। নামেই চলছে আউটডোর। ইনডোরে হাতে গোনা রোগী। কোথাও আবার আবাসিক চিকিৎসকই নেই। চিকিৎসকদের অনেকের নামই তালিকায় রয়েছে, কিন্তু কাজে নেই। জয়শ্রীদেবীর প্রশ্ন, ‘‘এই অবস্থায় পড়ুয়াদের হাতেকলমে পড়াবেন বা ডাক্তারি শেখাবেন কারা? কেস স্টাডিই বা কী করে করবেন ডাক্তারি পড়ুয়ারা?’’ এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ওভারসাইট কমিটি তা হলে কী ভাবে ওই সব মেডিক্যাল কলেজকে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দিল?

কমিটির অন্যতম সদস্য শিব সারিন বলেন, ‘‘এগুলি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে বাইরের কাউকে কিছু বলার অনুমতি নেই।’’ কমিটির অন্য এক সদস্য বিনোদ রাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর সচিব বলে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি একাধিক বার সময় দিয়েও কথা বলেননি। জবাব দেননি এসএমএস-এরও।

এমসিআইয়ের কর্তাদের অভিযোগ, সশরীরে এই সব কলেজে না-ঘুরে শুধু ওয়েবসাইট দেখে এবং মৌখিক আশ্বাসের ভিত্তিতে ওভারসাইট কমিটি অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। জয়শ্রীদেবীর বক্তব্য, ‘‘কী আর বলব! ওই কমিটিতে স্বনামধন্য সকলে রয়েছেন। এটুকু বলতে পারি, মেডিক্যাল শিক্ষার মানের সঙ্গে আপস করা অন্যায়।’’ এমসিআই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টকে জানাবে না? জয়শ্রীদেবীর ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ক্ষমতা সীমিত। পরিদর্শন করে কী পেলাম তা সরকারকে আর কমিটিকে জানাতে পারি কেবল।’’

ওভারসাইট কমিটির অনুমতি পেয়ে এ বছর ছাত্র ভর্তি করেছে এমন কিছু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের অবস্থা জানতে গিয়ে ডাক্তারি-শিক্ষার এই বেহাল দশা আরও পরিষ্কার হল।

হরিয়ানার পানিপথের একটি মেডিক্যাল কলেজ ১৫০টি আসনে ছাত্র ভর্তি করেছে। প্রত্যেকের থেকে ১১ লক্ষ ৩১ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এদের ৩০০ শয্যার হাসপাতাল সম্পর্কে নিজস্ব ওয়েবসাইটেই বলা রয়েছে—‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন।’ অর্থাৎ রোগী নেই, তাই কেস স্টাডির সুযোগও নেই পড়ুয়াদের।

উত্তরপ্রদেশের সাহজাহানপুরের একটি মেডিক্যাল কলেজ ও রোহিলখণ্ড হাসপাতালের অধ্যক্ষ মধু সিংঘলের সচিব বলে পরিচয় দিয়ে এক জন আবার রাখঢাক না-করেই বললেন, তাঁদের ৩০০ শয্যার হাসপাতালে মাসে ১৫-২০ জনের বেশি ভর্তি হয় না। এখন যেমন ১৮ জন রয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘রোগী ভর্তির সংখ্যা দিয়ে কী করবেন? এমবিবিএস পাশের সার্টিফিকেট পেলেই তো হল।’’

মধ্যপ্রদেশের বরেলির একটি কলেজের এক কর্তা জানালেন, এমবিবিএসে ভর্তির সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও তাঁরা ১১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ছাত্র ভর্তি করে চলেছেন এখনও। কারণ, তাঁদের কাছে ‘খবর’ আছে, সরকার ভর্তির সময়সীমা বাড়াবে! ওই রাজ্যেই গুনা জেলার এক কলেজের কর্তা বললেন, ‘‘আমাদের ৩৫০ শয্যার হাসপাতাল। কিন্তু চলতি বছর এখনও পর্যন্ত ৪৪ জন রোগী হয়েছে। বড় অপারেশন হয়েছে ৯টা। সিজার হয়েছে ১টা। নতুন কলেজ, তাই রোগী একটু কম। ধীরে ধীরে হয়ে যাবে। ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা অসুবিধা হবে না।’’

এই অবস্থায় দেশ জুড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে আশঙ্কায় নানা মহল। ডিগ্রির আড়ালে প্রশিক্ষণের খামতি ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর বলেই মনে করছেন অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন