বৃহস্পতিবার কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দেবাশিস রায়।
সুপ্রিম কোর্টে ঘায়েল হয়ে ফিরল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এবং তাঁর দলও।
সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দরজায় সিবিআই কড়া নাড়ছে দেখে মরিয়া হয়েই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল। আর্জি ছিল, সিবিআই তদন্তের উপরে নজরদারি করুক শীর্ষ আদালত। পাশাপাশি, সারদা তদন্ত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হচ্ছে, তার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক। আজ এই দুই আর্জিই খারিজ করে দিয়েছেন বিচারপতি টি এস ঠাকুর ও বিচারপতি সি নাগাপ্পন। তাঁদের বক্তব্য, সিবিআই তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ যখন উঠছে না, তখন আদালতের নজরদারির কোনও প্রয়োজন নেই। আর সংবাদমাধ্যম তার কাজ করছে, তাতে বাধা দেওয়ার কোনও কারণ নেই।
সারদা মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে যে ভাবে দল ও সরকারের মুখ পুড়ল, তাতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ। তাঁদের মতে, এই মামলা করাই উচিত হয়নি। সিবিআই যাঁকে তলব করার পরে মামলা করার তোড়জোড় শুরু হয়, সেই মুকুল রায় এ দিন কোনও মন্তব্য করেননি। দিল্লিতে থাকলেও তিনি আদালতে যাননি। মামলা খারিজ হয়ে যাওয়ায় তাঁর মধ্যে কোনও তাপউত্তাপও দেখা যায়নি। উল্টে গোটা বিষয়টি থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে মুকুল তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, “আমি তো দলের মুখপাত্র নই।” আর মুকুল-ঘনিষ্ঠ এক নেতার দাবি, “দাদা তো গোড়া থেকেই মামলা করার বিপক্ষে ছিলেন।”
তৃণমূল সূত্র বলছে, মুকুল রায়কে সিবিআই ডাকার পরে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্রমশ তারা মাথার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আর মুকুলের সঙ্গে যে হেতু মমতার দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সে হেতু তিনি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে কী বলবেন, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়, কালিম্পঙের ডেলো বাংলোয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের বৈঠকের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন মুকুল। তিনি নিজে অবশ্য সে কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু সিবিআই সূত্রের খবর, জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ডেলোয় মমতা-সুদীপ্ত বৈঠক হয়েছিল বলে মেনে নিয়েছেন মুকুল। এই অবস্থায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে সিবিআই তদন্তে রাশ টানার একটা মরিয়া চেষ্টা হয়। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টে মামলা করাটা সেই চেষ্টারই অঙ্গ।
রাজ্য সরকার তথা তৃণমূলের ধারণা ছিল, বিজেপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সিবিআই-কে ব্যবহার করছে, এই অভিযোগ এনে মামলা করে আদালতের নজরদারিতে তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারলে খানিকটা বাঁধ দেওয়া যাবে। আর সারদা কেলেঙ্কারিতে তৃণমূল নেতাদের জড়িয়ে যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া বন্ধ হলে দলের ভাবমূর্তি কিছুটা রক্ষা পাবে।
কিন্তু আজ শীর্ষ আদালত যা বলেছে, তাতে সুরাহা তো দূরস্থান, শাসক দলের বিপদ আরও বাড়লো বলেই মনে করা হচ্ছে।
কারণ, বিচারপতিরা সিবিআই-কে বলেছেন, তারা যদি মনে করে সারদা ছাড়া অন্য বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্ত করার দরকার নেই, তা হলে তারা তা না-ই করতে পারে। কারণ বিপুল সংখ্যক মামলার তদন্ত করতে গেলে মূল বিষয় থেকে নজর সরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সিবিআই আদালতে এ ব্যাপারে আবেদন জানালে তা গ্রহণ করা হবে। যার অর্থ হলো, সিবিআই এ বার পূর্ণশক্তিতে সারদা কেলেঙ্কারির বৃহত্তর ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করার কাজে হাত দিতে পারবে।
সিবিআই কর্তারাও বলছেন, আদালতের এই নির্দেশের ফলে তাঁদের উপরে বোঝা অনেকটাই কমে গেল। সারদা ছাড়া অন্যান্য সংস্থার বিরুদ্ধে ১৯৩টি মামলায় আগেই চার্জশিট পেশ হয়ে গিয়েছিল। এত দিন ওই সব মামলার শুনানি বন্ধ ছিল। এখন রাজ্য প্রশাসনকেই শুনানি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
তৃণমূলের পক্ষে আরও বিপদের কারণ, শীর্ষ আদালতে সিবিআইয়ের তোলা অভিযোগ। তদন্তকারী সংস্থার তরফে বলা হয়, অভিযুক্ত নেতা-মন্ত্রীদের আদালতে পেশ করার সময় তৃণমূল কর্মীরা হুমকি দিচ্ছেন। যা শুনে আদালত বলে, চাইলে এ ব্যাপারে নিম্ন আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে সিবিআই।
শাসক দলের বিপদের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের বিড়ম্বনাও আজ বাড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতিরা সরকারের আইনজীবী কপিল সিব্বলকে প্রশ্ন করেন, সিবিআই তদন্ত নিয়ে রাজ্য এত উদ্বিগ্ন কেন? চিন্তিত তো হওয়ার কথা সিবিআই যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাঁদের! সিবিআই সারদা-তদন্তে গাফিলতি করছে, এমন কোনও প্রমাণও আজ আদালতে দাখিল করতে পারেনি সরকার। তারা সংবাদমাধ্যমে তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে, এই অভিযোগও প্রমাণ করতে পারেনি তারা। উল্টে বিচারপতিরা প্রশ্ন তুলেছেন, রাজ্য সরকার বা তৃণমূল সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে কেন?
শীর্ষ আদালতের কাছে তৃণমূল তার লিখিত আবেদনে অভিযোগ করেছিল, কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সিবিআই-কে কাজে লাগাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি-র তিন নেতা অমিত শাহ, সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ও রাহুল সিংহের কথাতেই কাজ করছে সিবিআই। বিজেপি নেতারা সিবিআই তদন্ত নিয়ে যেমন ভবিষ্যৎবাণী করছেন, তেমনটাই ঘটছে। কিন্তু এ দিন বিচারপতিরা গোড়াতেই স্পষ্ট বলে দেন, তাঁরা কোনও রাজনৈতিক বিতর্ক শুনতে চান না।
রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খাওয়ায় বিরোধীরা স্বাভাবিক ভাবেই উজ্জীবিত। যাঁর দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার জেরে সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত, সেই কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “রাজ্য সরকার বেতন-পেনশন দিতে পারছে না। অথচ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে সুপ্রিম কোর্টে এসে বেআইনি দাবি করছে। অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে।” আর, বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “তৃণমূল সরকার অনেক আশা নিয়ে কংগ্রেসের হাতেপায়ে ধরে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল। কিন্তু আদালত বলে দিয়েছে, সিবিআই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করছে। বিজেপির সঙ্গে তাদের কোনও সংযোগ নেই।”
এ দিন তৃণমূলের একমাত্র সান্ত্বনা, তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ খারিজ হয়ে যাওয়া। সিবিআই তৃণমূল নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার পরেই আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সোনালি গুহরা সল্টলেকে সিজিও কমপ্লেক্সের সামনে ধর্নায় বসেছিলেন। এর পর মদন মিত্রকে গ্রেফতারের পর খোদ মুখ্যমন্ত্রী দলবল নিয়ে রাস্তায় নামেন। যে হেতু সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত হচ্ছে, তাই তদন্তের বিরোধিতা করা আদালত অবমাননা এই যুক্তিতে জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। কিন্তু শীর্ষ আদালত সেই প্রসঙ্গে ঢুকতে চায়নি।
তৃণমূল নেতাদের বড় অংশই অবশ্য এতে বিরাট খুশি হওয়ার কারণ দেখছেন না। তাঁদের মতে, দু’দুটো মামলায় গো-হারা হওয়ার ক্ষতে এটা কোনও প্রলেপই নয়। গোদের উপরে বিষফোড়াটুকু হলো না, এই যা!