যাদবপুরের পথে সুরঞ্জন, প্রশ্ন সেই স্বশাসন নিয়ে

দু’দফায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় উপাচার্য হিসেবে তাঁর কার্যকাল শেষ হচ্ছে আগামী বছর। তার আগেই যাদবপুরের উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়ে সুরঞ্জন দাসকে পাঠাতে চাইছে রাজ্য সরকার। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরঞ্জনবাবুর বিকল্প কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে কিছু সময় লাগবে বলে সরকারি সূত্রের খবর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৩:৫০
Share:

দু’দফায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় দফায় উপাচার্য হিসেবে তাঁর কার্যকাল শেষ হচ্ছে আগামী বছর। তার আগেই যাদবপুরের উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়ে সুরঞ্জন দাসকে পাঠাতে চাইছে রাজ্য সরকার। তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুরঞ্জনবাবুর বিকল্প কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে কিছু সময় লাগবে বলে সরকারি সূত্রের খবর।

Advertisement

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। চার মাস আগে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে অভিজিৎ চক্রবর্তীকে অপসারণের পর থেকে যাদবপুরে এখনও স্থায়ী উপাচার্য নেই। শেষ পর্যন্ত সেই শূন্যস্থান ভরাট করার জন্য সুরঞ্জনবাবুকে যাদবপুরে পাঠানোর সরকারি প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যাদবপুরের উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য গঠিত সার্চ কমিটির প্রথম পছন্দ সুরঞ্জন দাস। আচার্য হিসাবে কমিটির ওই সুপারিশেই অনুমোদন দিয়েছেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তবে নতুন দায়িত্ব নিতে সুরঞ্জনবাবুর একটু সময় লাগবে।’’

সুরঞ্জনবাবু অবশ্য এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি মঙ্গলবার শুধু বলেছেন, ‘‘আমার কাছে এখনও কোনও চিঠি আসেনি। যদি তা আসে, তা হলে বিবেচনা করে দেখব।’’ সরকারি সূত্রের খবর, আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর হাতে দায়িত্ব অর্পণ করার আগে রাজ্যপাল সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তখনই সুরঞ্জনবাবু এই বিষয়ে তাঁর মতামত জানাতে পারেন।

Advertisement

পদ্ধতিগত বিষয় যা-ই হোক, সুরঞ্জনবাবুকে যাদবপুরে পাঠাতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে দু’টি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রথমত, গত কয়েক দিনে রাজ্য সরকারের মনোভাবেই স্পষ্ট, যাদবপুরে নতুন দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সুরঞ্জনবাবুই ছিলেন সরকারি পছন্দ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি পছন্দে সিলমোহর দেওয়ার জন্য সার্চ কমিটির মাধ্যমে শুধু কি আইনের দায় মেটানো হল? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসন, নিজস্ব বিবেচনা— এ সব কি আদৌ গুরুত্ব পেল? বাম জমানায় প্রয়াত অনিল বিশ্বাসের আমলে যে ভাবে আলিমুদ্দিনের পছন্দের ব্যক্তিই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় বসতেন, এ ক্ষেত্রে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়মরক্ষা করে কি ঘুরপথে সরকারি নিয়ন্ত্রণই কায়েম করা হচ্ছে? প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষা জগতের অনেকেই। শিক্ষামন্ত্রী পার্থবাবু অবশ্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ‘‘এর মধ্যে স্বশাসনে হস্তক্ষেপের কি আছে? সার্চ কমিটি যাঁর নাম প্রথম পছন্দ হিসাবে সুপারিশ করেছে, শিক্ষা দফতর তার সঙ্গে একমত হয়েছে।’’

আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, কলকাতার উপাচার্যের মেয়াদের এক বছর বাকি থাকতেই তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যেতে এই তৎপরতা কেন? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বর্তমান আধিকারিককে নতুন দায়িত্বে নিয়ে আসার রাস্তা পরিষ্কার করতেই কি সুরঞ্জনবাবুকে যাদবপুরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? যদিও শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘কলকাতার বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সেখানেও সার্চ কমিটি গড়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।’’ শিক্ষা জগতের কেউ কেউ অবশ্য পাল্টা বলছেন, সরকার তার ‘পছন্দ’ বেছে দিলে সার্চ কমিটি যে একই সুপারিশ করতে পারে, যাদবপুরের ক্ষেত্রে সুরঞ্জনবাবুর নামে সিলমোহর দেওয়া থেকেই তো তা স্পষ্ট!

যাদবপুরের নতুন উপাচার্য হিসাবে সুরঞ্জনবাবুই কেন সরকারের পছন্দ? সরকারি সূত্রের খবর, খোদ মুখ্যমন্ত্রীই সুরঞ্জনবাবুকে ওই পদে চান। শিক্ষা দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘যাদবপুরে আগের উপাচার্যকে নিয়ে বিড়ম্বনার পরে ওই দায়িত্বে এমন কাউকে খোঁজা হচ্ছিল যিনি প্রশাসক হিসাবে দক্ষ। সেই সঙ্গেই যাদবপুরের সঙ্গে কোনও পুরনো সম্পর্ক আছে, এমন কাউকে চাওয়া হচ্ছিল না। সুরঞ্জনবাবু দু’টি শর্তই পূরণ করতে পারবেন।’’ তা ছাড়া, সুরঞ্জনবাবুকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে প্রথম দায়িত্বে বসানো হয়েছিল বাম জমানাতেই। পরে তৃণমূল জমানাতেও তিনি ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ অর্জন করেছেন। তাই বর্তমান শাসক দলের ‘ঘরের লোক’ কাউকে বসানো হল, এমন কথা তাঁর ক্ষেত্রে বলার সুযোগ কম বলেই সরকারি সূত্রের ধারণা।

বস্তুত, একটি সূত্রের ইঙ্গিত, প্রবল বিক্ষোভের মুখে অভিজিৎবাবু সরে যাওয়ার সময় থেকেই সুরঞ্জনবাবুকে যাদবপুরের উপাচার্য পদে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল সরকার। অভিজিৎবাবুর আমলে গত অগস্টে যাদবপুরে যে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল, তার তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সুরঞ্জনবাবু সরকারের আস্থা অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়া, কলকাতার মতো বিস্তৃত ও আয়তনে বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সুরঞ্জনবাবু বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সুরঞ্জনবাবু স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর গবেষণা। তাই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা— দু’য়ের নিরিখেই উপাচার্য পদের দাবিদার হিসেবে ধারেভারে কম নন সুরঞ্জনবাবু।

আনুষ্ঠানিক ভাবে গত ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত যাদবপুরের উপাচার্য পদের জন্য প্রার্থীদের আবেদন ও মনোনয়ন গ্রহণ করেছে সার্চ কমিটি। তার সপ্তাহ খানেক পরেই ছুটিতে যান সার্চ কমিটির চেয়ারপার্সন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। আবেদন, মনোনয়ন মিলিয়ে প্রায় ৪০ জনের নাম জমা পড়েছিল। তালিকায় থাকা অনেকেই যোগ্যতার নিরিখে সুরঞ্জনবাবুর থেকে পিছিয়ে নেই বলে জানাচ্ছে একটি সূত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রবীণ শিক্ষকও ছিলেন সেই তালিকায়। কিন্তু সেগুলির কোনওটিই সার্চ কমিটির বিবেচনায় আসেনি। সরকারের পছন্দের প্রার্থী সুরঞ্জনবাবু অবশ্য তখন সেই তালিকায় ছিলেন না। সরকারি সূত্রের খবর, নবান্ন ও রাজভবনের সুপারিশে শেষ পর্যন্ত সার্চ কমিটির চেয়ারপার্সন অনুরাধাদেবী সুরঞ্জনবাবুর নামটি সুপারিশ করেন। সেই নামটিই চূড়ান্ত প্যানেলের শীর্ষে রাখে সার্চ কমিটি। তবে চূড়ান্ত প্যানেলে কাদের নাম থাকছে, সে ব্যাপারে সার্চ কমিটির কোনও বৈঠক হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন উচ্চশিক্ষা দফতরের অনেকে। অনুরাধাদেবী অবশ্য কোনও ব্যাপারেই মুখ খুলতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই গোপনীয় বিষয়ে আমি কিছু বলব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন