ঝুঁকি: কোনও সতর্কতা ছাড়া, এ রকমই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলে অস্ত্রোপচারের যন্ত্র তৈরির কাজ। বারুইপুরে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
রোগ নিরাময়ের যন্ত্রেই বাসা বেঁধেছে রোগ। অথচ তা নির্মূল করতে অমিল উপযুক্ত চিকিত্সার। ফলে রোগ ছড়িয়ে প্রায় পঙ্গুদশা বারুইপুরের বর্ষপ্রাচীন অস্ত্রোপচারের যন্ত্র তৈরির শিল্পের| ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শিল্পের উন্নয়নে সরকার অবিলম্বে পদক্ষেপ না করলে কোমায় চলে যাবে এই শিল্প।
উচ্চমানের ইস্পাতের অভাব, যন্ত্র তৈরির মান্ধাতার পদ্ধতি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ধুঁকছে এই শিল্প| বর্তমানে বারুইপুর পুর এলাকা, কল্যাণপুর, খোদার বাজার, ধোপাগাছি, বলাখালি এবং পুরন্দরপুরের কয়েকশো ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে এই কুটিরশিল্প।
এলাকা ঘুরলেই নজরে পড়ে, কোথাও দরমার বেড়ার আড়ালে অথবা পলেস্তরাহীন ঘরে, সিমেন্টের খড়খড়ে অথবা মাটির মেঝেতে উবু হয়ে বসে অন্ধকারে কাজ করে চলেছেন কারিগরেরা। অভিযোগ, যন্ত্র তৈরির পরে যে অ্যাসিড পালিশ করা হয়, সেখানে কোনও সতর্কতা ছাড়াই কাজ করেন কারিগরেরা। এমন পরিবেশে কাজ করায় অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে এবং কাজের মানও নেমে যাচ্ছে বলে দাবি তাঁদের একাংশের। ব্যবসায়ীদের দাবি, উচ্চমানের ইস্পাত না ব্যবহার করায় যন্ত্রে মরচে ধরার অভিযোগ আসছে কাজের বরাত দেওয়া সংস্থাগুলি থেকে| সমস্যা রয়েছে আরও। যেমন, ইস্পাতের রড হাতে পিটিয়ে যন্ত্র তৈরি করায় সব এক আকৃতির হয় না, ফলে বাতিল হয় বহু যন্ত্র। হাতে তৈরি করায় সময়ও লাগে অনেক।
ন্যায্য মজুরির অভাব এই শিল্পে আরও এক সমস্যা। বারুইপুরের ব্যবসায়ী নিখিল চক্রবর্তী ও কল্যাণপুরের প্রসেনজিৎ কর্মকারদের আক্ষেপ,— এক জন মজুর দৈনিক ৪০০ টাকা পান| সেখানে দক্ষ কারিগরকে ২৫০ টাকা দেওয়া হয়| কারণ, এর বেশি টাকা দিলে লাভ থাকবে না। ব্যবসায়ীদের দাবি, এ সবের জন্য বহু কারিগর সরে যাচ্ছেন। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ১৯৯৭ সালে এই শিল্পে প্রায় ৩০০০ কারিগর ছিলেন। এই মুহূর্তে ৬০ শতাংশ কারিগর অন্য কাজে চলে গিয়েছেন। ফলে খ্যাতি হারাচ্ছে বারুইপুরের এই শিল্প। অথচ আশির দশকে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রের রফতানি শুরু হওয়ার পরে ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছিল শিল্প, জানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, গত এক দশকে পরিকাঠামোর অভাবে পাকিস্তানের শিয়ালকোট এবং চিনের সঙ্গে দাম এবং মান, সব দিকেই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বারুইপুর|
১৯৫৬ সালে বারুইপুরের পিয়ালিতে তত্কালীন সরকার ‘সার্জিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট সার্ভিস স্টেশন’ নামে একটি পরিষেবা কেন্দ্র গড়ে তোলে। ১৯৯০ সাল থেকে দশ বছর কেন্দ্রীয় সরকারের দু’টি সংস্থা এই শিল্পের উপরে সমীক্ষা চালায়। তাতে পরিষেবা কেন্দ্র পুনরুজ্জীবিত করতে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর বছর কয়েক পরে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে পিয়ালির পরিষেবা কেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্র বসানো হয়। অভিযোগ, কিছু দিন পর থেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অকেজো হয়ে পড়ে যন্ত্র। এই শিল্পের ব্যবসায়ীদের একমাত্র সংগঠন ‘বারুইপুর সার্জিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বাসিমা) এ নিয়ে কোনও তত্পরতা দেখায়নি| ফলে উন্নতমানের ইস্পাত এক জায়গায় জমা করার ‘স্টিল ব্যাঙ্ক’ও আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি|
নথি বলছে, আশি বছর আগে ১৯৩৭ সালে বারুইপুর পুর এলাকা ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছিল অস্ত্রোপচারের যন্ত্র তৈরি। ওই সব এলাকা থেকে কয়েক জন কর্মকার তখন মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন অস্ত্রোপচারের যন্ত্রের দোকানে কাজ করতে আসতেন| তাঁদের তিন কর্মকার ভাই শিল্পের কারিকুরি শিখে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অন্যদের মধ্যে। সেই শুরু। ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে সার্জিকাল ছুরি-কাঁচি, ফরসেপ, নিডল হোল্ডার, অস্থি সংক্রান্ত যন্ত্র, ইএনটি-র যন্ত্র, ল্যাপারোস্কোপির যন্ত্র, ফেকোর লেন্স।
প্রথমে কামারশালে স্টিলের রড পিটিয়ে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। এর পরে কয়েক ধাপে সেটি সম্পূর্ণ করে পালিশ ও সবশেষে প্যাকেজিং হয়। পুরো প্রক্রিয়া হয় এই এলাকাগুলিতে। বাসিমার সেক্রেটারি কমল দাসের মতে, ‘‘ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ স্বাভাবিক। ২০০৫ সাল নাগাদ কেন্দ্র ও রাজ্য মিলে ৪ কোটি ৬১ লক্ষ টাকায় শিল্পের আধুনিকীকরণের চেষ্টা হয়েছিল| সঠিক পরিকল্পনা ও আন্তরিকতার অভাবে নষ্ট হয়েছে প্রায় সবটা। ফলে বাসিমার প্রায় কোনও ভূমিকাই আর নেই।’’
ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ— মুখ্যমন্ত্রী শিল্প আনতে বিদেশে যাচ্ছেন। অথচ ঘরের কাছে এমন একটা শিল্প মরে যাচ্ছে। সে দিকে নজর দেওয়া হলে, বারুইপুর সার্জিকাল ক্লাস্টার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেত।
বর্তমানে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প মিশে গিয়েছে শিল্প দফতরের সঙ্গে। এই শিল্প বাঁচাতে শিল্প দফতর কী করছে জানতে ফোনে যোগাযোগ করা হয় মন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি।