বিসর্জনের পথে চলেছেন মা দুর্গা। কাঁধ দিচ্ছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ!
মহরমের শোভাযাত্রায় যাবে পাড়ার ছোটরা। তাদের সাজিয়ে দিচ্ছেন বৌদি-কাকিমারা!
পিঠোপিঠি দুর্গাপুজো এবং মহরমে সম্প্রীতির এমন সব ছবিই ধরা পড়ল উত্তর ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে।
পুলিশের হিসেবে, উত্তর ২৪ পরগনায় এ বার ১৭৯৬টি দুর্গাপুজো হয়েছে এবং ৫৪টি মহরমের শোভাযাত্রা বেরিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। পুলিশের হিসেবে বাইরে দু’টি ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা আরও বেশি। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির জন্যই পুজো, বিসর্জন বা মহরমে সে ভাবে কোনও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি পুলিশের।
এই জেলার বারাসত, শাসন, দেগঙ্গা, বসিরহাট, আমডাঙা, দত্তপুকুর, বিড়া, বনগাঁ-সহ বিভিন্ন এলাকায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষই মিলেমিশে শারদোৎসব পালন করেছেন। মহরমে সামিল হয়েছেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত দত্তপুকুরের সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো ‘বুড়িমার পুজো’য় বিসর্জনের সময়ে মণ্ডপ থেকে সুতি নদীঘাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ মা দুর্গাকে কাঁধে করে নিয়ে যান মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এটাই রীতি। সম্প্রীতির সেই ছবি এ বারও অটুট। তা ছাড়া, পুজোর ক’দিন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে পুজো করেন। রান্নাবান্না, পাত পেড়ে খাওয়া-দাওয়াও চলে একসঙ্গে।
বিসর্জনের পরে মন খারাপ বয়ে গিয়েছে কদম্বগাছির আব্দুর রহিমের। আবার এক বছরের অপেক্ষা! তাঁর কথায়, ‘‘ছোটবেলায় জানতাম, মূর্তিপুজো দেখা ঠিক নয়, যোগ দেওয়া তো দূরের কথা। আর এখন আমার ছেলেমেয়ের বায়নায় ঠাকুর যেখানে তৈরি হয়, সেখানেও যেতে হয়। পুজোয় নতুন জামা-কাপড় তো চাই-ই। বিসর্জনের পর থেকে মনটাও খারাপ।’’
কদম্বগাছির গভর্নমেন্ট কলোনি শ্রেয়সী এবং শিবতলা পুজো কমিটির সভাপতির নাম আরশাদউজ্জামান। পুজোর চাঁদা তোলা থেকে, প্রতিমা আনা— সব কিছুই তাঁকে দেখভাল করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘পুজোর যাবতীয় আয়োজন ছাড়াও একসঙ্গে খাওয়া, অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, গরিবদের জামাকাপড় দেওয়া— সবই আমরা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে করেছি। বিসর্জনেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছি।’’
দশমীর পরের দিনই ছিল মহরম। শাসনের কালসারা মহরম কমিটির তাজিয়া বের করে। তা দেখতে হিন্দুরাও রাস্তার দু’পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ওই কমিটির সদস্য আকবর আলির সাজ বরাবরই প্রশংসিত হয়। এ বারও সেজেগুজে তাজিয়া নিয়ে বের হন আকবর। তাঁকে এ বারও যথারীতি সাজিয়ে দিয়েছেন প্রতিবেশি ‘কাকিমা’ বাসবী মল্লিক। আমডাঙায় তাজিয়া দেখতে উপচে পড়া ভিড় সামলাতে দেখা গেল নবীন পাল, হরি দে’র মতো এলাকার যুবকদের।
পশ্চিম খিলকাপুরের শেখ মনুয়ার আলি বলেন, ‘‘আমাদের এলাকায় প্রচুর গরিব মানুষ বাস করেন। দুর্গা, কালীপুজো, মহরম, ঈদের সময়েই তাঁরা শুধু সব দুঃখ ভুলে আনন্দ করেন। আমরা সবাই তাঁদের সাহায্যের চেষ্টা করি। এ বার পুজোয় তিন হাজার শাড়ি এবং সাতশো লুঙ্গি বিলি করা হয়েছে।’’
সম্প্রীতির এমন সুর শোনা গিয়েছে জেলার আরও নানা প্রান্তেও।