Tala Bridge

নস্টালজিয়া, দূরাগত ভবিষ্যৎ এবং এক ঊনষাটের প্রৌঢ়ের পুনর্জন্ম

মাঝেরহাট উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পর কলকাতা শহরের সব সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেছিল রাজ্য সরকার। সেই সময় রোগ ধরা পড়েছিল টালা সেতুর।

Advertisement

সারমিন বেগম

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২১ ১২:৫৫
Share:

কাজ চলছে টালা সেতুর। নিজস্ব চিত্র

আকুলী বাড়ির দোতলার জানালা দিয়ে অপলকে চেয়ে থাকেন অর্ঘ্য। পাইকপাড়া মোড় থেকে টালা ব্রিজের ডান পাশ দিয়ে একটু এগোলেই আকুলী বাডি়। দোতলার জানলা দিয়ে তাকালে একেবারে পাশে টালা ব্রিজ। নজর একটু উপরে তুললে বিখ্যাত টালার ট্যাঙ্ক। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অর্ঘ্য তাকিয়ে থাকেন। দেখতে পান, স্কুলের পোশাক পরে টালা ব্রিজের উপর দাদু দ্বারিকানাথের হাত ধরে বাসের জন্য অপেক্ষমান সাত বছরের অর্ঘ্যকে।

Advertisement

আকুলীদের ষষ্ঠ প্রজন্মের সন্তান অর্ঘ্য নির্মীয়মান টালাব্রিজ দেখেন আর ভাবেন, কবে আবার উঠতে পারবেন ব্রিজে। কবে আবার সাত বছরের স্কুলছাত্রের নস্টালজিয়ার সঙ্গে মিশে যাবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রের বর্তমান। যিনি চারতলার ছাদে দাঁড়িয়ে কলকাতার আকাশরেখা দেখাতে দেখাতে টালা ব্রিজের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘‘ওই ব্রিজের উপর টালা ব্রিজ নামে একটা বাস স্টপ ছিল। স্কুল যাওয়ার জন্য ওই বাস স্টপ থেকেই বাসে উঠতাম। বন্ধুদের মধ্যে সময় ঠিক করা থাকত। শর্ত ছিল, সকলে না আসা পর্যন্ত কেউ বাস ধরবে না। ওই বাস স্টপেই সকলে অপেক্ষা করতাম।’’

মাঝেরহাট উড়ালপুল ভেঙে পড়ার পর কলকাতা শহরের সব সেতুর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেছিল রাজ্য সরকার। রোগ ধরা পড়েছিল ৫৯ বছর বয়সি টালা সেতুর। বিপর্যয়ের সম্ভাবনা এড়াতে ২০২০ সালে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু ভাঙা শুরু হয়। বছর কুড়ির অর্ঘ্য তখন ভুবনেশ্বরে। কলিঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল টেকনোলজির ছাত্র। ‘‘সে বছর দোলের সময় বাড়ি ফিরে দেখি জোরকদমে টালা ব্রিজ ভাঙার কাজ চলছে। কাগজে আগেই পড়েছিলাম। কিন্তু সামনে থেকে একটু একটু করে পুরো সেতুটা ধুলোয় মিশে যেতে দেখে মন খারাপ লাগছিল’’, বলছিলেন অর্ঘ্য।

Advertisement

২০০৮ সাল। টালা সেতুতে দাদু দ্বারিকানাথের সঙ্গে ছোট্ট অর্ঘ্য। নিজস্ব চিত্র

উত্তর শহরতলির সঙ্গে শহরের যোগাযোগের অন্যতম জীবনরেখা বিটি রোডের টালা ব্রিজ। শ্যামবাজার মোড় পেরিয়ে ব্যারাকপুর ব্রিজের পরেই শুরু। রেললাইনের উপর দিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে পাইকপাড়ায়। ধারেভারে গুরুত্বপূর্ণ এই ব্রিজ পুনর্নির্মাণের কাজও এগোচ্ছে গুরুত্ব দিয়ে। করোনার মধ্যেও দাঁড়ি-কমা পড়েনি। শ্যামবাজারের দিকে পিলারের উপর গার্ডার বসে গিয়েছে। স্ল্যাব বসানোর প্রস্তুতি চলছে। বুধবার দুপুরে দেখা গেল জনা দশেক কর্মচারী সেতুর ওই অংশের উপর কাজ করছেন।

রেল-রাজ্যের চিঠি চালাচালির ধাক্কা গিয়ে লেগেছিল মাঝেরহাট উড়ালপুল আবার গড়ে তোলার কাজে। টালা সেতু ব্যতিক্রম। রেল-রাজ্য সঙ্ঘাত এড়িয়ে পিলার বসানোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে রেলের জায়গার উপরেও। তবে দুই প্রান্তের কাজের তুলনায় মাঝের অংশের কাজ অনেকটাই বাকি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সেতুর দু’দিকের র‌্যাম্পের তুলনায় মাঝের অংশে বেশি দুর্বল ছিল। সেতু ভাঙার জন্য বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি আনা হয়েছিল। ভাঙার সময় কাঁপুনিতে তাঁদের পুরনো বাড়িতে ফাটল ধরেছে বলে জানাচ্ছিলেন আকুলী বাড়ির কর্তা দীপঙ্কর আকুলী। এলাকার বাসিন্দাদের অনুযোগ, সেতুর নিচের রাস্তা আগের থেকে উঁচু হয়ে গিয়েছে। ফলে বর্ষার জমা জল বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ছে।

টালা ব্রিজ গড়ে তোলার কাজ শেষ হতে হতে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ। নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মচারী বলছিলেন, ‘‘বর্ষার জন্য কাজে কিছু অসুবিধা হলেও সব পরিস্থিতিতেই কাজ চালু রাখা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে অন্য কাজ বন্ধ হলেও টালা ব্রিজ তৈরির কাজ বন্ধ হয়নি। সেতু নির্মাণেরর সঙ্গী জড়িত কর্মীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। করোনা পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, যাতে সঠিক সময়ে কাজ শেষ করা যায়।’’

নতুন সেতু তৈরি হচ্ছে। তৈরি হবে নতুন স্মৃতি। নতুন ব্রিজে জন্ম নেবে আরও অনেক অর্ঘ্যর গল্প। যিনি বলছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় দাদু ব্রিজের উপর থেকে নিচের রেললাইন দেখাতে নিয়ে যেতেন। আগে তো ধোঁয়া-বেরনো ট্রেনও চলত। আমরা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নিচ দিয়ে ট্রেন যাওয়া দেখতাম।’’ আকুলীদের ষষ্ঠ প্রজন্মের সন্তান অর্ঘ্য দোতলার জানালা দিয়ে নির্মীয়মান টালাব্রিজ দেখেন আর ভাবেন, কবে আবার উঠতে পারবেন ব্রিজে। কবে আবার সাত বছরের স্কুলছাত্রের শৈশবের সঙ্গে মিশে যাবে একুশ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ার যৌবন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement