শ্রীরামপুর আদালত চত্বরে চায়ের দোকানে ব্যস্ত পাপ্পু।—নিজস্ব চিত্র।
সেরেস্তা থেকে অর্ডার এসেছে। অপেক্ষা করা যাবে না। তাই দোকানের বাকি খদ্দেরদের দাঁড় করিয়ে ছুট লাগালেন তিনি।
গত এক দশকে এটাই রোজনামচা বৈদ্যবাটির পাপ্পুর। শ্রীরামপুর কোর্টের মুহুরি থেকে আইনজীবী, বিচারক— সকলেই ছেলেটাকে একডাকে চেনেন। আর আদালতে চা বিক্রি করতে করতেই ছেলেটি এলএলবি পরীক্ষায় পাশ করে ফেললেন। তাঁর এই সাফল্যে আইনজীবী থেকে আদালতের কর্মীদের আনন্দের শেষ নেই। পাপ্পুর এ হেন উত্থানে খুশি বিচারকেরাও। যে আদালতে বছরের পর বছর কেটলি হাতে চা-বিস্কুট বিক্রি করে আসছেন, সেখানেই কালো কোট গায়ে জড়িয়ে এজলাসে মামলার ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে সওয়াল করবেন, এই ভেবে খুশিতে ভরে গেল তাঁর মুখ।
পাপ্পু ওরফে বুদ্ধদেব চক্রবর্তীর বাড়ি বৈদ্যবাটি পুরসভার বাগেরবাগানে। বাবা-মা আর দুই দাদার সঙ্গে থাকেন। অভাবের সংসার। বছর দশেক আগে বাবা গোপাল চক্রবর্তী শ্রীরামপুর আদালতে এক চিলতে দোকান করেন। সেখানে চা-বিস্কুট, হাতে গড়া রুটি, ঘুগনি, আলুর দম পাওয়া যায়। দোকান বলতে আদালত ভবন লাগোয়া একফালি জায়গা। অ্যাসবেসটসের চাল। দু’পাশে জাল দিয়ে ঘেরা। রোদ-বৃষ্টিতে সমস্যা হয়। দোকানে বসে খাওয়ার জায়গা নেই। অনেকে দাঁড়িয়ে খান। আইনজীবীদের সেরেস্তায় বা বিভিন্ন আদালতের ভিতরে হরদম ডাক পড়ে। দিনভর দোকান সামলাতেই হিমসিম পাপ্পু।
ক্লাস এইটে পড়ার সময় থেকে তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে চা বেচতে শুরু করেন এখানে। তখন শেওড়াফুলির বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তেন। শ্রীরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে ভদ্রেশ্বরের সুকান্ত মহাবিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে স্নাতক হন ২০১৩ সালে। ওই বছরই এলএলবি কোর্সে ভর্তি হন। বাবা অসুস্থ। দোকানে আসতে পারেন না। নিয়মিত কলেজ যেতে গিয়ে দোকানের ক্ষতি হচ্ছে। সে জন্য দূরশিক্ষার সাহায্য নেন। ভর্তি হন পটনার রঘুনাথপ্রসাদ ল’কলেজে। সম্প্রতি ‘ফাইনাল ইয়ারের’ রেজাল্ট বেরিয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
কিন্তু পড়াশোনার খরচ?
পাপ্পু জানান, স্কুলে পড়ার সময় থেকেই আইনজীবী বা মুহুরিরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। বইপত্র বা টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছেন তাঁরা। আইন নিয়ে পড়া পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের অনেকের সাহায্যও মিলেছে। কেউ আইনের বই হাতে তুলে দিয়েছেন। কেউবা আবাসনে জটিল বিষয় বুঝিয়ে দিয়েছেন। পড়াশোনা চালানোর পাশাপাশি আইনজীবীদের কাছে থেকে বিভিন্ন মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছেন। সুযোগ পেলেই আদালত কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে সওয়াল-জবাব শুনেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার শিক্ষার অনেকটাই আদালতে হয়েছে। এ বার আইনজীবী হিসেবে লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করব। এখানে আসার সুবাদেই মাধ্যমিকের পর থেকে অ্যাডভোকেট হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। তবে সকলের সাহায্য ভালবাসা না পেলে হয়তো এটা সম্ভব হত না।’’
মা রূপাদেবী রুটি করছিলেন। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘‘দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। তার পরে ক্লান্ত শরীরেই ছেলে পড়তে বসত। আইনজীবীদের সাহায্য ছাড়া ছেলের সাফল্য আসত না।’’ কী বলছেন আইনজীবীরা? আইনজীবী অংশুমান চক্রবর্তী, দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়, মানস পর্বত, গৌতম চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘পাপ্পুর সাফল্যের পিছনে রয়েছে অধ্যবসায়।’’ আর মুহুরি রাজু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ মিত্রর কথায়, ‘‘বাবা-মা’র মুখ উজ্জ্বল করে ভবিষ্যতে ও নামী অ্যাডভোকেট হয়ে উঠুক, সেটাই চাই।’’