অনিল-পথেই শিক্ষায় অস্থায়ীর ভূত

পদের নাম অস্থায়ী। সেটাই স্থায়ী রোগ! রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার ঘাড়ের উপরে এখন চেপে বসেছে অস্থায়ী নিয়োগের ভূত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অস্থায়ী, রেজিস্ট্রার অস্থায়ী, কোথাও সহ-উপাচার্য অস্থায়ী! শিক্ষা প্রশাসনের আরও নানা পদে অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়েই চলছে কাজ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৬ ০৪:৫৩
Share:

পদের নাম অস্থায়ী। সেটাই স্থায়ী রোগ!

Advertisement

রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার ঘাড়ের উপরে এখন চেপে বসেছে অস্থায়ী নিয়োগের ভূত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অস্থায়ী, রেজিস্ট্রার অস্থায়ী, কোথাও সহ-উপাচার্য অস্থায়ী! শিক্ষা প্রশাসনের আরও নানা পদে অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়েই চলছে কাজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য সুগত মারজিত ইস্তফা দিতে চেয়ে রোগের উপসর্গকে ফের সামনে এনে ফেলেছেন মাত্র। শিক্ষা মহলের অন্দরে খোঁজ করলে জানা যাচ্ছে, রোগের জীবাণু আসলে ঘুরছে বিগত জমানা থেকে! যা হতে পারতো বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথাব্যথা, তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হতে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে!

নিয়ম মানলে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়। যা তাদের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গ। সার্চ কমিটি নাম পাঠাবে, রাজ্যপাল তথা আচার্য আনুষ্ঠানিক ভাবে উপাচার্যকে নিয়োগ করবেন। কিন্তু এই ব্যবস্থায় অন্তর্ঘাতের শুরু অনিল বিশ্বাসের হাতে। বাম জমানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় ‘নিজেদের লোক’ বসানোই ছিল সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদকের পরিকল্পনা। শিক্ষা জগতে যার নাম ‘অনিলায়ন’।

Advertisement

শিক্ষা মহলের একাংশের বক্তব্য, লক্ষ্যপূরণের জন্য অস্থায়ী-কৌশল আমদানি করেছিলেন অনিল। যত দিন না উপাচার্যের মতো আসনে নিজেদের ‘বিশ্বস্ত লোক’ পাওয়া যাচ্ছে, তত দিন অস্থায়ী কাউকে দায়িত্ব দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়াই ছিল কৌশল। পরে নিজেদের লোক পাওয়া গেলে তাঁর জন্য আসন ছেড়ে দিতেন অস্থায়ী। আবার অস্থায়ী উপাচার্যই শাসকের মন রাখার কাজে সফল হয়ে গেলে তাঁকে ক্ষেত্রবিশেষে দেওয়া হতো পূর্ণ দায়িত্ব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের এই রাজনীতিই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি থেকে উপাচার্য নিয়োগের ভাবনা সরকারের ঘাড়ে এনে ফেলেছে বলে শিক্ষাবিদদের মত।

উপাচার্য বসানোর রাশ হাতে নেওয়ার সেই পরম্পরা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরেও সরকারের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে চলেছে! কলকাতা ও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী উপাচার্যেরা কাজ চালাচ্ছেন। তাঁদের যেখান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে, সেই সব পদেও আবার অনেক ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিয়োগ করতে হয়েছে! হইচই শুরু হওয়ায় মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অস্থায়ী পদের তালিকা নিয়ে কথা বলেছেন শিক্ষাসচিব বিবেক কুমারের সঙ্গে। যত দ্রুত সার্চ কমিটি যাতে তৈরি করে ফেলা যায়, এখন সেই তোড়জোড় শুরু হয়েছে। অথচ এই কাজে সরকারের মাথা ঘামানোর কথাই নয়!

একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অস্থায়ী নিয়োগের পিছনে আসল পরিকল্পনা দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। অস্থায়ী উপাচার্য দিয়ে এত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়।’’ আগেও কি এমন হতো না? আনন্দদেবের মতে, দলতন্ত্র অবশ্যই ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও নিয়োগের ক্ষেত্রে যা গুণমান ছিল, এখন তা-ও নেই।

বাম জমানার শেষ দিকের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘অস্থায়ী নিয়োগ করে এই ভাবে কাজ চালানো উপাচার্য পদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অসম্মান। ব্যক্তি হিসেবে কারও বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু অস্থায়ী ভিত্তিতে যত বেশি রাখা হবে, তাঁরা তত সরকারের লোক হয়ে উঠবেন, এটাই স্বাভাবিক!’’ সুদর্শনবাবুর দাবি, হাতে-গোনা ব্যতিক্রম বাদে তাঁর জমানায় অন্তত এমন অস্থায়ীয় হিড়িক ছিল না। সার্চ কমিটি নাম পাঠাত রাজভবনে। একাধিক নাম থাকলে বর্ণানুক্রমে তা দেওয়া থাকত। রাজ্যপাল যখন পরামর্শ করতেন, উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী অবশ্যই মতামত দিতেন। তবে এখানে উল্লেখ্য, সুদর্শনবাবু উচ্চ শিক্ষা দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অনিলবাবুর প্রয়াণের পরে। যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিছুটা হলেও শিক্ষাকে রাজনীতির মুষ্টিমুক্ত করার চেষ্টা করছেন।

পার্থবাবু আবার প্রত্যাশিত ভাবেই সরকারের নিয়ন্ত্রণের মানসিকতাকে দোষ দিচ্ছেন না। তাঁর বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গাফিলতিও অনেক ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। নইলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি আগেই গড়ে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে ফেলা যেত। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘একে ভোটের জন্য বেশ কিছু দিন ব্যস্ততা ছিল। যোগ্য লোক পাওয়াও একটা ব্যাপার। তা ছাড়া, আমাদের সময়ে ১৫টা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। সেখানে প্রথম বার তো অস্থায়ী উপাচার্যই আনতে হবে!’’ পার্থবাবু আরও জানিয়ে রাখছেন, তাঁদের সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে শিক্ষার কিছু ক্ষেত্রে যে সব ফাঁক-ফোকর ছিল, দ্বিতীয় ইনিংসে সে সব বুজিয়ে ফেলা হবে।

একই সঙ্গে শাসক দলের এক প্রথম সারির নেতা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘নিজের লোক বসাতে গেলে অস্থায়ী নিয়োগই লাগে নাকি? সার্চ কমিটিতে সরকারের প্রতিনিধি থাকেন। চাইলে সার্চ কমিটিকে দিয়েও নিজের লোক আনা যায়!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন