‘ব্লাড দিচ্ছি, বেচুন! মেয়েটাকে ছাড়ুন’ শুনেও মন গলেনি নার্সিংহোমের

নার্সিংহোম থেকে মেয়ে যে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরল, তা দেখে যেতে পারলেন না বাবা।

Advertisement

সৌমেন দত্ত ও অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

বর্ধমান ও শিকারিপাড়া শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩৪
Share:

বর্ধমানের সেই অভিযুক্ত নার্সিংহোম।—নিজস্ব চিত্র

নার্সিংহোম থেকে মেয়ে যে শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরল, তা দেখে যেতে পারলেন না বাবা।

Advertisement

হাসপাতালের দালালচক্রের হাতে পড়ে সদ্য প্রসূতি মেয়ে চুমকিকে বর্ধমানের নবাবহাটের পিজি নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের শিকারিপাড়ার মলুটি গ্রামের চাষি তপন লেট (৪৬)। বিল হয়েছিল ৪২ হাজার টাকার। জোগাড় হয়েছিল ১৩ হাজার টাকা। মেয়েকে অন্যত্র সরাতে গেলে প্রাণ সংশয় হতে পারে বলে ভয় দেখানো হয়েছিল নার্সিংহোমের তরফে। মঙ্গলবার রাতে গ্রামের ধারের একটি গাছে গলায় দড়ি দেন তপনবাবু। তাঁর পরিবারের দাবি, মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তার জেরেই আত্মহত্যা করেছেন তিনি।

তপনবাবুর মৃত্যুর পরেও চুমকিকে ছাড়তে রাজি ছিল না নার্সিংহোম। তাঁদের এক পড়শি এ-ও বলেন, ‘আমরা ব্লাড দিচ্ছি। সেটা বেচুন। মেয়েটাকে ছেড়ে দিন।’ তাতেও নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের মন গলেনি বলে অভিযোগ। শেষে জেলা প্রশাসনের কর্তারা হস্তক্ষেপ করায় শুক্রবার বিকেলে ছাড়া পান চুমকি। তখনও জানেন না, বাবা আর নেই।

Advertisement

তপনবাবুর মেয়ে চুমকির বিয়ে হয়েছে বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে। গত ১৪ তারিখ তাঁর ছেলে হয়। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার তিন-চার দিনের মধ্যেই চুমকির তীব্র খিঁচুনি ও মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। জামাই গুরুতর অসুস্থ। তাই যাবতীয় ঝক্কি সামলাচ্ছিলেন দু’কাঠা জমিতে ভাগ-চাষ করে সংসার চালানো তপনবাবুই। গত রবিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) চুমকিকে রামপুরহাট হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। তপনবাবুর স্ত্রী অণিমা লেটের দাবি, সেখানকার ডাক্তার অল্প কিছু প্রশ্ন করেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ করেন।

চুমকিকে যখন বর্ধমান নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে, তখন এগিয়ে আসেন সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স (নিশ্চয় যান)-এর এক চালক। অণিমাদেবীর দাবি, ‘‘ওই চালক বলে, ‘বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করানোয় অনেক হ্যাপা। কলকাতার পিজি হাসপাতালের নাম শুনেছেন তো? বর্ধমানেও একটা পিজি আছে। সেখানে চলুন’। পিজি শুনে ভাবলাম, সরকারি হবে। তাই আর না করিনি।’’

নার্সিংহোমের বিলের টাকা মেটাতে না পেরে আত্মঘাতী চাষি তপন লেট।

ওই অ্যাম্বুল্যান্স চালকের খোঁজ মেলেনি। অনেকেরই ধারণা, তিনি কোনও দালাল চক্রের সঙ্গে যুক্ত। তাই গরিব ওই পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নবাবহাটের পিজি নার্সিংহোমে। প্রশ্ন উঠেছে চুমকিকে তড়িঘড়ি বর্ধমানে রেফার করে দেওয়া নিয়েও। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘চুমকির রোগটার নাম ‘পোস্ট-পার্টাম কনভালশন’। যে কোনও সরকারি হাসপাতালেই এর চিকিৎসা হয়।’’ অর্থাৎ, রামপুরহাট হাসপাতালের চিকিৎসক আর একটু দায়িত্ববান হলে পরবর্তী সমস্যাগুলি হতো না বলেই মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকেই।

রামপুরহাট স্বাস্থ্য-জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ব্রজেশ্বর মজুমদার বলেন, ‘‘কেন ওই রোগিণীকে অন্যত্র রেফার করা হল, কেনই বা সরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের চালক রোগিণীর পরিবারকে বিভ্রান্ত করলেন, আমরা তদন্ত করে দেখব।’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীও বলেন, ‘‘সব খতিয়ে দেখা হবে।’’

আরও পড়ুন:
সরছে মাটি, টিকবেন কি মরাঠা স্ট্রংম্যান

তবে চুমকিকে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলেও ঘটনা এত দূর গড়াত না বলে মনে করছে তাঁর পরিবার। নার্সিংহোমে চিকিৎসার খরচ কত দাঁড়াবে সোমবার সকালে তা জানতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে তপনবাবুর। অণিমাদেবীর দাবি, তাঁদের বলা হয়, ৪০-৫০ হাজার টাকা জোগাড় করতে। তাঁর কথায়, ‘‘টাকার অঙ্ক শুনে আমার স্বামী চুমকিকে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যেতে চাইলে বলা হয়, কাচের ঘর (আইসিইউ) থেকে বার করলেই মেয়ে নাকি মারা যাবে।’’

টাকার জোগাড় করতে মঙ্গলবার গ্রামে ফেরেন তপনবাবু। গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে ১১ হাজার টাকা দেন। অণিমাদেবীর কথায়, ‘‘টাকার জোগাড় করতে যাচ্ছেন বলেই মঙ্গলবার রাত ৯টায় বাড়ি থেকে বেরোন।’’ বুধবার সকালে তপনবাবুর ঝুলন্ত দেহ মেলে।

এই সেই বিল।

সৎকার মেটার পরে গ্রামবাসী মানিক মণ্ডল, কল্যাণ রায় ও কাজল চট্টোপাধ্যায় শুক্রবার চুমকিকে নিতে নার্সিংহোমে আসেন। ম্যানেজার ইনামুল শেখকে তপনবাবুর মারা যাওয়ার খবর জানান। অনুরোধ করেন চুমকিকে ছাড়তে। ম্যানেজার বলেন, ‘‘২৯ হাজার টাকা বাকি। তিন হাজার টাকা ছাড়তে পারি।’’ মানিকবাবুরা বলেন, ‘‘১৫ হাজার আছে। পরিস্থিতি বুঝে দয়া করুন।’’ তাঁদের বলা হয়, ‘‘টাকা না দিলে থানায় জানিয়ে মেয়েটিকে হোমে পাঠানো হবে।’’ তখন গ্রামবাসীরা রক্ত দিতে চান। তাতেও কাজ হয়নি। তপনবাবুর তিন পড়শি ফোনে বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায়কে বিষয়টি জানান। খবর যায় জেলাশাসক সৌমিত্র মোহনের কাছেও। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সুর বদলায় নার্সিংহোম। অভিযোগ উড়িয়ে নার্সিংহোমের অন্যতম অংশীদার শেখ জয়নালের দাবি, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই বিল না মেটালেও আমরা কিছু বলি না। ডাক্তার সুস্থ করতে চাইছিলেন বলেই ছাড়তে আপত্তি করা হচ্ছিল।’’ সংশ্লিষ্ট ডাক্তার তথা নার্সিংহোমের আর এক অংশীদার শিল্পী গুপ্তর স্বামী ডি কে গুপ্ত বলেন, ‘‘মহিলাকে আরও দু-এক দিন রাখতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ওঁর বাড়ির অবস্থা বিচার করে দশ দিন পরে আসতে বলা হয়েছে।’’

বিকেল ৪টে নাগাদ ছাড়া পেয়ে বাড়ির পথে রওনা হন চুমকি। সদ্যোজাত নাতিকে ফিডিং বোতলে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে অণিমাদেবীর আক্ষেপ, ‘‘নার্সিংহোমটার জন্যই তুই দাদুকে দেখতে পেলি না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন