পশ্চিম বাংলাই থাকুক

আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল সম্ভবত ১৯২৭-এ। মায়ের জন্মসূত্রে নাম ছিল চন্দ্রকলা। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে মায়ের নতুন নাম হল অপর্ণা। কেন, জানি না। বোধহয় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্বশুরবাড়ি ওই পুরনো ধরনের ধরনের নাম পছন্দ করেনি।

Advertisement

দেবেশ রায়

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৬ ০২:১২
Share:

আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল সম্ভবত ১৯২৭-এ। মায়ের জন্মসূত্রে নাম ছিল চন্দ্রকলা। বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে মায়ের নতুন নাম হল অপর্ণা। কেন, জানি না। বোধহয় ইংরেজি-শিক্ষিত শ্বশুরবাড়ি ওই পুরনো ধরনের ধরনের নাম পছন্দ করেনি। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয় ১৯৬৩-তে। তখন ওর বয়স ২৪-২৫-ই হবে। এমএ পাশ করেছে। আমার দুই দিদির নাম সুধা ও জ্যোৎস্না। তার সঙ্গে মিলিয়েই ওর নাম অমিয়া। ঠাকরদারই দেওয়া, যিনি চন্দ্রকলাকে অপর্ণা করেছিলেন। বিয়ের পরে তার শ্বশুরবাড়িতে আমার ছোট বোনের নাম বদলে দেওয়া হল। ওর বড় জায়ের নাম অমিয়া। তাই ওর নাম হল ইন্দ্রাণী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির গেজেটভুক্ত নামও বদলে গেল।

Advertisement

আমি এমন ঘটনা জানি, যেখানে শ্বশুর আর জামাইয়ের একই নাম। তাঁদের কাউকে তো নাম বদলাতে হয়নি। বাবার নামেই বরের পরিচয় দিয়ে গিয়েছে মেয়ে আজীবন।

এ একেবারে লাজলজ্জাহীন পুরুষ-আধিপত্য। পুরুষের নাম বিধাতা দেন আর মেয়েদের নাম দেয় পুরুষরা। পুরুষও তো বিধাতা।

Advertisement

রাষ্ট্র তো পুরুষ। নইলে রাষ্ট্রের প্রতীকের নাম রাষ্ট্রপতি হবে কেন? রাজ্য সরকার যদিও রাষ্ট্র নয়। কিন্তু ভাবেসাবে তো রাষ্ট্রই যেন। হাবরার এক কাউন্সিলরই নিজেকে রাষ্ট্র ভেবে ঘুষি মেরে এক জনের নাক ফাটিয়ে দিতে পারে!

সবিস্তার পড়তে উপরে ক্লিক করুন।

সেই পুরুষ-অহঙ্কারই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নাম বদলাতে চাইতে পারে। কেন? না, সর্ব ভারতীয় সরকারি সম্মেলনগুলিতে ওয়েস্ট বেঙ্গল হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গকে সকলের শেষে বক্তৃতা করতে হয়। বর্ণানুক্রমিকতায় যদি বক্তৃতা করতে হয়, তা হলে কাউকে-না-কাউকে তো শেষে বলতে হবেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে ইয়েমেন ও জাইরে-কে তো শেষে বলতেই হবে। সেই কারণে তো ইয়েমেন বা জাইরে-র নাম আলবানিয়া হতে পারে না।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মন্ত্রিসভা বা বিধানসভার যদি তেমন ক্ষমতা থাকে, তা হলে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজি বর্ণমালা ‘এ’ দিয়ে শুরু না করে ‘ডব্লিউ’ দিয়ে শুরু করতে পারেন।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের আত্মছলনার ক্ষমতা বিস্ময়করের চাইতেও বিস্ময়কর। সভায় আগে বক্তৃতা করে দিতে চাই— এমন একটা সন্দেহজনক সুবিধের সুযোগ নিতে তাঁরা অনেকেই নিদান দিলেন, পশ্চিমবাংলা নামটিই ভুল, গোড়া থেকেই। ওটা তো বদলানোই উচিত। উত্তর, দক্ষিণ, পুব নেই যার, তার খামোখা পশ্চিম থাকবে কেন। যখন পূর্ব বাংলা ছিল, তখন না-হল পশ্চিম বাংলা বলার যুক্তি ছিল। এখন কেন?

১৯০৫ সালে ‘পূর্ব বাংলা ও অসম’ বলে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। সেই প্রথম ‘পূর্ব বাংলা’ একটা রাজনৈতিক পরিচয় পায়। ১৯৪৭-এ ‘পশ্চিম বাংলা’ একটি রাজনৈতিক পরিচয় পায়। সেটা বদলানো মানে তো ইতিহাসকে বদলানো।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

পশ্চিম বাংলা তো পশ্চিম বাংলাই— গঙ্গার দক্ষিণে পশ্চিমের টুকরো। উত্তর বাংলা বলে কোনও রাজনৈতিক পরিচয় নেই। পূর্ব পাকিস্তানেও নর্থ বেঙ্গল ছিল, বাংলাদেশেও নর্থ বেঙ্গল আছে। সেটা ভৌগোলিক পরিচয়। রাজনৈতিক পরিচয় নয়। দেশভাগ তো হয়েছিল ক্যাবিনেট মিশনের পুরনো প্ল্যান অনুযায়ী। তাতে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার হিন্দু-সংখ্যাধিক্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়েছিল।

বামফ্রন্টের আমলেও এই জিগির একবার উঠেছিল। সেবার রাজ্যের নাম বদলাতে না পেরে, খামোখা ক্যালকাটা নামটা খারিজ করা হল। যে-নামে দুশো বছর ধরে শহরটার পরিচয় দুনিয়া জানল, সেই নামটাই যত নষ্টের গোড়া বলে স্থির করা হল।

এই রাজ্যের জন্মনাম ‘পশ্চিম বাংলা’, সাংবিধানিক নাম ‘পশ্চিম বাংলা’, এখনকার রাজ্য সরকার তৈরি হয়েছে পশ্চিম বাংলার বিধানসভার ভোটে। তাঁদের ভোট দেওয়া হয়েছে পশ্চিম বাংলার রাজ্য চালাতে, পশ্চিম বাংলার নাম বদলাতে নয়।

পশ্চিম বাংলা, পশ্চিম বাংলাই থাকবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement