চুড়োয় চিড়।— নিজস্ব চিত্র।
পরপর দুটি বড় মাপের ভূমিকম্প কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে মন্দিরনগরী নবদ্বীপের মঠমন্দিরের প্রধানদের মনেও। ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পে বেশ কিছু মন্দিরের চূড়ায় হালকা চিড় ধরিয়েছিল। তারপরে ফের কম্পনের পর সেই চিড় রীতিমতো ফাটলের আকার নিয়েছে। নবদ্বীপে বর্ষাকালে বন্যা, মাঝে মধ্যেই বিগ্রহ চুরির তালিকায় এ বার নতুন সংযোজন ভূমিকম্প। যা নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন নবদ্বীপ।
সম্প্রতি এই ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে নবদ্বীপ দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে। ১০৮ ফুট উঁচু নবরত্ন মন্দিরটির সর্বাঙ্গে ফাটল ধরেছে। মঠের তরফে মধুসূদন মহারাজ বলেন, “গত ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পে মন্দিরের প্রধান চূড়াতে হালকা ফাটল ধরেছিল। তারপর ফের যে আবার ওই মাপের ভূমিকম্প হবে তা বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয় বারের কম্পনে কার্যত মন্দিরের ৯টি চূড়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি আবার একটা ওই মাপের কম্পন হয়, তা হলে হয়তো পুরোটাই ভেঙে পড়বে। আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার কথা ভাবছি।” শুধুমাত্র ইট দিয়ে তৈরি অত উঁচু চূড়া কী ভাবে মেরামত করা হবে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
নবদ্বীপের মহানির্বাণ মঠের চূড়ার গম্বুজেও ফাটল ধরেছে। প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান উচ্চতা বিশিষ্ট, বিশালাকার এক গম্বুজ বিশিষ্ট মহানির্বাণ মঠের একটি মাত্র চূড়ার গায়ে লম্বা ফাটল দেখা দিয়েছে। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে তৈরি হওয়া ওই মন্দিরের নির্মাণ শৈলির বৈশিষ্ট হল সুউচ্চ গম্বুজটি ফাঁপা। ফলে গম্বুজের বাইরের দিকে যে ফাটল চোখে পড়েছে তা ভিতরে তার কী অবস্থা তা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় রয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ।
প্রায় দুশো বছর আগে তৈরি নবদ্বীপের হরিসভা মন্দির আদতে ছিল প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের টোল। পরপর ভূমিকম্পে চিন্তায় পড়েছেন হরিসভা কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে হরিসভার বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “আমাদের মন্দিরের চূড়া নেই বলে হয়ত বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু প্রায় দুশো বছর আগের প্রযুক্তিতে চুনসুরকি, ইট আর কড়ি-বরগা দিয়ে তৈরি ভারি পিলারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দির কতদিন এই ধরনের কম্পন সহ্য করতে পারবে তা নিয়ে উদ্বেগে আছি। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই কলকাতার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।”
নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমিতির সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপে বহু প্রাচীন মঠমন্দির রয়েছে। অনেকেরই অবস্থা জরাজীর্ণ। গঙ্গার তীরবর্তী হওয়ায় এতদিন বন্যা নিয়ে ভাবতে হত নবদ্বীপের মঠমন্দির কর্তৃপক্ষকে। এখন তার সঙ্গে যোগ হল ভূমিকম্পের মতো ভয়ঙ্কর একটি বিষয়ও। এই সব প্রাচীন নির্মাণ গুলিকে ভূমিকম্পের আঘাত থেকে যথা সম্ভব রক্ষার জন্য প্রত্যেকেই নিজের মতো করে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।’’
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নবদ্বীপে প্রাচীন এবং নবীন দু’ধরনের নির্মাণশৈলীর মন্দিরই আছে। কিছু মন্দির বয়সে প্রাচীন হলেও সেগুলি কম্পনে এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অন্যদিকে রয়েছে আধুনিক স্থাপত্য ও বিজ্ঞান মেনে হালে গড়া বিরাটাকার একাধিক মন্দির। একশো দেড়শো বছরের পুরনো মন্দিরের নির্মাণ কৌশল এবং সাম্প্রতিক কালের মন্দিরের নির্মাণ কৌশলের মধ্যে অনেক ফারাক থাকলেও যে কোন বড় নির্মাণ কাজেই স্থাপত্য বিজ্ঞানের সাধারন কতগুলি শর্ত থাকে। সেই শর্ত মেনে যে সব মন্দির গড়া হয়নি তাঁদের ঝুঁকি কিছুটা বেশিই। বহু ক্ষেত্রেই পুরনো মন্দিরের নির্মাণ যাঁরা করিয়েছিলেন তাঁরা আজ আর নেই। সে ক্ষেত্রে দেরি না করে যত তাড়াতাড়ি বাস্তুকারদের সাহায্য নেওয়া দরকার।
বর্তমানে নবদ্বীপের অন্যতম বড় মন্দির কেশবজী গৌড়ীয় মঠের মধুসূদন ব্রহ্মচারী জানিয়েছেন, প্রায় ১২০ ফুট উঁচু মূল মন্দির গড়ার আগে মাটির নীচে ৮০ ফুট ‘পাইলিং’ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এখন গুরুদেবের সমাধি মন্দিরের নির্মাণ কাজ চলছে। দোতলা ভবনের জন্য আমরা ৪৫ ফুট পাইলিং করিয়েছি। আশা করছি এই ধরনের কম্পনে আমাদের মন্দিরের উপর তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না।”