পরকীয়া ফৌজদারি অপরাধ নয়, রায় সুপ্রিম কোর্টের। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
সে বার যখন বৃষ্টি হল খুব, গাঁয়ের মাতব্বরেরা মাথা নেড়ে নিদান দিলেন— তা বৃষ্টি হলে হবে, সভা বসবে সাঁঝ নামলে। যুক্তি ছিল, বিচারের জন্য তো আর কাজ কামাই করা যায় না! সবাই ফিরলে এক জোট হয়ে বসা যাবে।
কথাটা মুখে-মুখে রটে গেল গোটা গাঁয়ে। ভরসন্ধেয় পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপে সে দিন থিকথিকে ভিড়। কেউ এসেছেন ছাতা নিয়ে। কারও ব্যাগে খয়াটে পলিথিন। মণ্ডপে জ্বলছে একখানা ডুমো বাল্ব। তবুও হাতে-হাতে এসেছে বেশ কিছু লণ্ঠন। বাল্বের বিকল্প। কারণ, সেই সন্ধেয় আলোটা বড় জরুরি। বেলডাঙার মাধুরপুকুর গ্রামে বর্ষা-সন্ধের আঁধার মুছে সালিশি দেখতে হবে যে! ভিড়ের মধ্যে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির তরুণী। লন্ঠনের শিখার মতোই সে মাঝেমধ্যেই কেঁপে-কেঁপে উঠছে। অজস্র চোখ গিলে খাচ্ছে তাকে। ফিসফাস, হাসি, এ-ওর গায়ে পড়ে মস্করা, ‘খুব রস অ্যাঁ!’ মেয়েটি মাটির দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে, যেন মনে মনে বলছে, পায়ের তলায় মাটি দু’ভাগ হয়ে যাক! তা হলে হয়ত মুক্তি! কিন্তু মুক্তি কি আর মুখের কথা!
টালির বাড়ির দাওয়ায় এগারো বছর আগের সেই সন্ধেটা ঠারেঠোরে মনে আছে তাঁর আজও। বত্রিশ বছরের তরুণী এখন বেলডাঙা শহরে তিন বাড়ি কাজ করে মাসে দু’হাজারের রোজগেরে। ছেলে অষ্টম শ্রেণি, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন সদ্য। বলছেন, ‘‘সে দিন ঘরে বসে পাড়ারই এক জনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বললে যে এমন পাপ হয় জানতাম না!’’ গলা বুজে আসে তাঁর অভিমানে। সে দিনের সভায় নানা জনের নানা যুক্তি, অজস্র প্রশ্নের পরে জেরবার মেয়েটি জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ বলেছি কথা, অন্য লোকের সঙ্গে।’ মাঝ রাতে, লণ্ঠনের আলোয় সভা জুড়ে সে কি সোল্লাশ। ছিটকে আসছে কটুক্তি। হাসির হররা। এ বার, এ বার কি হবে? ফিসফাস মাতব্বরদের মধ্যে। সকলেই মনে-মনে আঁক কষছেন। কিন্তু কারও হিসেবই জুতসই হচ্ছে না। কারণ, এ বড় জটিল অঙ্ক। মাধুরকর গ্রাম বর্ষার সেই রাতে শুনেছিল— যৌবনের মেয়াদ যত দিন, ততো দিন আর এ গাঁয়ে ঠাঁই নেই তাঁর।
মাতব্বরদের এক জন কিছু সময় পরে জানিয়ে দিলেন, ‘‘এখন মেয়েটির বয়স কুড়ি। আগামী কুড়ি বছরের জন্য ওকে নির্বাসন দেওয়া হল। আমরা ভেবে দেখলাম, চল্লিশের পরেই যৌবন ফুরোবে। তার পরে সে গ্রামে ফিরতে পারে। কারণ, তখন আর ও এমন অপরাধ করতে পারবে না।’’ কী ‘অপরাধ’? পড়শি এক যুবকের সঙ্গে কথা বলছিলেন নিজের ঘরে। গ্রামের দুই যুবক তা দেখে ফেলে। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে থেকে শিকল তুলে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রামে। থানা-পুলিশ নয়, বসেছিল সালিশি সভা।
খবর পেয়ে প্রশাসন অবশ্য তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিল গ্রামে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু যৌবনের মেয়াদ-হারা সেই সন্ধেটা এখনও বিঁধে রয়েছে তাঁকে।